সরকারি চাকুরেরা বেতনের শতকরা পাঁচ ভাগ প্রণোদনা পাচ্ছেন জুলাই থেকে। আর বছরে তাদের শতকরা পাঁচ ভাগ ইনক্রিমেন্টও আছে। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে এটা তাদের জন্য সুখবর হলেও বেসরকারি খাতে যারা কাজ করেন তাদের জন্য কোনো সুখবর নেই।
উল্টো তারা নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়তে পারেন। সরাকরি চাকুরেরা মোট শ্রমশক্তির শতকরা পাঁচ ভাগেরও কম। তাই বিশ্লেষকেরা মনে করেন,” এভাবে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এতে বরং অসাম্য সৃষ্টি হতে পার। প্রয়োজন হলো মূল্যস্ফীতি কমানো এবং বাজারে যৌক্তিত মনিটরিং।” তবে পরিকল্পনামন্ত্রী মনে মনে করেন, “সরকারি চাকুরেদের এই প্রণোদনার ফলে বেসরকারি খাতে এক ধরনের চাপ তৈরি হতে পারে। ওখানেও বেতন বাড়তে পারে।”
দেশে বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৯১৮ জন। অর্থমন্ত্রণালয় আগে থেকেই এই প্রণোদনার হিসাবের কাজ শুরু করে। কারণ তারা যখন মহার্ঘ ভাতা দাবি করেছিলেন তখনই প্রধানমন্ত্রী সেটা না দিয়ে প্রণোদনা দেয়ার কথা বলেছিলেন। এই প্রণোদনার কারণে মূল বেতন বাড়বে না। ফলে বছরে সরকারি চাকুরেদের প্রণোদনা দিতে বাড়তি খরচ হবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে তারা বছরে নিয়মিত শতকরা পাঁচভাগ ইনক্রিমেন্ট পাবেন। এটা মূল বেতনের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়। তবে বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এই সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। সবাইকে হিসাবে আনলে এই খরচ আরো অনেক বাড়বে।
চলতি বজেটে (২০২৩-২৪) প্রণোদনার বাইরে বেতন-ভাতা বাবদ ৭০ হাজার ৭০১ কোটি টাকা এবং পেনশন বাবদ ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে বরাদ্দ ৯৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা।
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, পেনশনসহ অন্যান্য খরচ বাবদ বাবদ মোট বাজেটের ২২-২৮ শতাংশ ব্যয় হয়। আর গত এক দশকে তাদের বেতন ভাতা বাবদ সরকারের খরচ বেড়েছে ২২১ ভাগ বেড়েছে। সর্বশেষ জনশুমারি বলছে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। সেই হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীরা দেশের মোট এক শতাংশেরও কম। আর শ্রমবাজারে তারা পাঁচ শতাংশেরও কম।
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরেদের সর্বশেষ পে-স্কেল ঘোষণা করা হয় ২০১৫ সালে। এরপর আর নতুন কোনো পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়নি। তবে তারা প্রতিবছর শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে যাচ্ছেন।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাজমুল হক বলেন, “আমাদেরও প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়না। দুই-তিন বছর পর দেয়া হয়। আর মহার্ঘ ভাতা বা প্রণোদনা ভাতা নেই। সরকারি চাকুরেদের প্রণোদনা দেয়ার ফলে তাদের উপকার হবে। কিন্তু তাতে বিশাল জনগোষ্ঠীর কোনো উপকার হবে না। উল্টো আরো মূল্যস্ফীতি হবে। আমাদের বেতন না বাড়লেও তার চাপ আমাদের নিতে হবে। ২০১৫ সালে সরকারি চাকুরেদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। তখন এর প্রভাব পড়েছিলো বাজারে। তখনও মূল্যস্ফীতি হয়।”
তার কথা, “এখন বেসরকারি খাতের চেয়ে সরকারি চাকরিতে বেতন এবং সুযোগ সুবিধা বেশি। তাই এখন বিসিএস জবের প্রতি এত আগ্রহ তরুণদের।”
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, “সরকারি চাকুরেদের সরকার প্রণোদনা দেবে এতে আপত্তি করার কিছু নাই। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য সরকার কী করছে? যারা বেসরকারি খাতে কাজ করেন তারা তো কিছু পাচ্ছেন না। যেটা প্রয়োজন ছিলো তা হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। যার সুফল সবাই পেত। সরকার বলছে এটা শতকরা ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু কীভাবে সরকার সেটা করবে তার কোনো নির্দেশনা বাজেটে নেই। যেটা হবে তা হলো সরকারি চাকুরেদের প্রণোদনার ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। বাড়তে পারে অসাম্য। যার চাপ নিতে হবে সবাইকে।”
তিনি মনে করেন, “সামনে নির্বাচন তাই সরকারি চাকুরেদের খুশি রাখতে সরকার এটা করেছে। কারণ নির্বাচনে তাদের প্রভাব আছে।”
মে মাসে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বিবিএস-এর হিসেবে ৯.৯৪ ভাগ। যা গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ। সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলালউদ্দিন বলেন, “প্রকৃত মূল্যস্ফীতি সরকারি হিসাবের চেয়ে আরো বেশি। ফলে এই সময়ে দরকার ছিলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া কিন্তু সেটা নেয়া হয়নি। সরকারি চাকুরে মোট জনগোষ্ঠীর এক ভাগের কম। তাই প্রশ্ন বাকিদের কী হবে? সরকার তো প্রাইভেট সেক্টরকে বেতন বাড়াতে বলতে পারে না। তারা করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খারাপ অবস্থায় আছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল।”
তার কথা, “সরকার এরপরও শ্রমিকদের ব্যাপারে আইএলওর নীতি যেন সবাই মানে, বেসরকাারি খাতে ব্যাপক বেতন বৈষম্য দূর করা, মিনিমাম ওয়েজ গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে করা- এসব নিয়ে কাজ করতে পারে।”
আর সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “সরকারে বাজেট, ফিসক্যাল পলিসি, মনিটারি পলিসি কোনো কিছুইতেই মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা আশা করেছিলাম বাজেট আলোচনায় মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যাপারে দিক নির্দেশনামূলক আলোচনা হবে, কিন্তু হয়নি। এসব না করে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশ সরকারি চাকুরেদের শতকরা পাঁচভাগ প্রণোদনা দিয়ে সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাদের জন্য সরকার কী করল?” তিনি বলেন, “সরকারি চাকরিজীবীরা এখন ইনক্রিমেন্ট মিলিয়ে মোট ১০ শতাংশ বেশি বেতন পাবেন। পাঁচ ভাগ প্রণোদনার জন্য সরকারকে বছরে আরো চার হাজার কোটি টাকা বেশি খরচ করতে হবে। এই টাকা কোন উৎস থেকে দেয়া হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু এর চাপও পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। আর এটা যদি বেসরকারি আর্থিক খাত থেকে ঋণ নিয়ে দেয়া হয় তারও নেতিবাচক প্রভাব আছে।”
সরকার বেসরকারি খাতকে আদেশ দিতে পারে না৷ তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মনে করেন, “সরকারি চাকরিজীবীদের এই প্রণোদনা দেয়ার ফলে বেসরকারি খাতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। এর ফলে তারাও হয়তো বেতন বাড়াবেন। তবে সরকার সরাসরি বেসরকারি খাতকে বেতন বাড়াতে বলতে পারের না। তাদের কোনো আদেশ দিতে পারে না। তারা বাড়ালে ভালো, সুখবর। না বাড়ালে সরকার কিছু করতে পারে না।”
তিনি বলেন,”সরকার সবার উপকারের জন্য মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে। বাজারেও মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো পণ্য আমদানি বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও ডলার সংকট, রিজার্ভ সংকট আছে। চাইলেই অনেক কিছু আমদানি করা যায়না। আর সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্যসহ সরকারের নানা প্রকল্প আছে।”
পাঁচ ভাগ প্রণোদনার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে কী না, জানতে চাইলে তিনি বলেন,”বাড়বে না। আমরা চাইছি আপাতত মূল্যস্ফীতি যেন আর না বাড়ে। এরপর কমানোর চেষ্টা করব।”
এসএইচ-০৪/২৮/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)