সরকারি কর্মকর্তাদের খরচের লাগাম টানতে আবারো সক্রিয় হয়েছে সরকার। কিন্তু এর আগে সরকারের এই অর্থ সাশ্রয়ের প্রচেষ্টা তেমন কাজে আসেনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘‘এবার খরচ কমাতে আগের চেয়ে কঠোর সরকার। আরো কমপক্ষে এক বছর আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে৷’’
অর্থমন্ত্রণালয় রোববার এক পরিপত্রে বলেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন গাড়ি কেনা বন্ধ থাকবে৷ আর সরকারি কর্মকর্তারা শুধুমাত্র বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া বিদেশ সফর করতে পারবেন না৷ ভূমি অধিগ্রহণ খাতে বরাদ্দ ব্যয় করা যাবে না৷ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২০ থেকে ২৫ শাতাংশ ব্যয় সাশ্রয় করতে হবে৷ সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, কর্পোরেশন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে৷ বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷
২০২১-২২ অর্থবছরে শেষ দিকে মে মাসে একই ধরনে নির্দেশনা ছিলো৷ যা ২০২২-২৩ অর্থবছরেও বহাল ছিলো৷ কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর ঠেকানো যায়নি৷ তারা নানা অজুহাতে বিদেশ সফর করেছেন৷ নিষেধাজ্ঞার পরও কতজন কর্মকর্তা বিদেশে গেছেন তার হিসাব জানা যায়নি৷ তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান স্বীকার করেছেন যে অনেকেই এই নিষেধজ্ঞা অমান্য করে সরকারি খরচে বিদেশ সফর করেছেন৷ যেমন ২০২২ সালের জুলাই মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২৫ জন কর্মকর্তাকে অষ্ট্রেলিয়া পাঠানোর জন্য সফরের ধরনই পাল্টে দেয়া হয়৷ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েরও ওই কর্মকর্তাদের অষ্ট্রেলিয়া সফর ছিলো এক্সপোজার ভিজিট৷ গত বছরের ১২ মে জারি করা পরিপত্রে এক্সপোজার ভিজিট নিষিদ্ধ ছিল৷ তাই এটার ধরন পরিবর্তন করে প্রশিক্ষণ সফর করা হয়৷
ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানসহ ওয়াসার ১১ জন কর্মকর্তা বিদেশে যান ২০২২ সালে পরিপত্র জারির পর৷ তাকসিম এ খান স্পেনের মাদ্রিদে ‘দ্য গ্লোবাল ওয়াটার সামিট’ সহ দুইটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছিলেন৷ তিনি সেখান থেকে আবার নেদারল্যান্ডসে যান আরেকটি সেমিনারে যোগ দিতে৷ আর ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে তুরস্ক যান ঢাকা ওয়াসার ছয় কর্মকর্তা৷
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ, সিষ্টেম ম্যানেজার মো.রফিকুল হক, সিনিয়র সিষ্টেম এনালিস্ট মো.ইকবাল জাভিদ ও সহকারী প্রোগ্রামার আল নাহিয়ান তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ নিতে পাঁচ দিনের সফরে মালয়েশিয়া যান৷
শ্রম সচিব এহছানে এলাহী এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদ শিক্ষাসফরে ডেনমার্ক যান৷ ১৫ মে থেকে ২১ জুন তারা সেখানে অবস্থানের পর সেখান থেকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যান৷
২০২২ সালে বিদেশ সফর বন্ধের পরিপত্র জারির পরও বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান স্ত্রীকে নিয়ে সিঙ্গাপুর সফরে যান একটি সম্মেলনে যোগ দিতে৷
তবে এবারের পরিপত্রে বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হলেও বেশ ফাঁকফোকড় রেখে দেয়া হয়েছে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে৷ পরিপত্রে বিদেশ সফরের ব্যাপারে বলা হয়েছে, বিদেশি কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠান বা উন্নয়ন সহযোগীর আমন্ত্রণে ও তাদের অর্থায়নে আয়োজিত বিদেশি প্রশিক্ষণে সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবেন৷ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশ থেকে দেয়া স্কলারশিপ, ফেলোশিপের আওতায় বিদেশি অর্থায়নে মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়ন করতে পারবেন৷ এ ছাড়া ঠিকাদার, সরবরাহকারী বা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে সরকারি কর্মকর্তা ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তারা পণ্যের গুণগত মান নিরীক্ষা করার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচলাক ড. ইফতেখরুজ্জামান বলেন, ‘‘বিদেশ থেকে আনা পণ্যের মান যাচাইয়ের জন্য বিদেশ যাওযার সুযোগ রাখা হয়েছে৷ এটা আমরা কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি৷ করাণ বর্তমান ডিজিটাল যুগে পণ্যের মান যাচাইয়ের জন্য বিদেশ যাওয়ার দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না৷ আর ঠিকাদারের অর্থে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ রাখা অনৈতিক৷ কারণ ঠিকাদার তার প্রাইসিং-এর মধ্যে এই খরচটি রেখে দেয়৷ তারা কোনো চ্যারিটি করে না৷ এখানে শেষ পর্যন্ত জনগণের টাকাই খরচ হয়৷’’
তার কথা, ‘‘নতুন পরিপত্র আরো একটু বিবেচনাপ্রসূত হওয়া দরকার৷ আর এটা যেন ঠিকভাবে মানা হয়৷ কারণ এর আগে এটা ঠিকভাবে মানা হয়নি৷ দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় এটা করা হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাবে না৷ কিন্তু এটার একটি গুরুত্ব আছে৷ এটা ঠিকভাবে মানা হলে সবার মধ্যে একটা মেসেজ যাবে৷ সবাই সাশ্রয়ী হবেন৷’’
তিনি মনে করেন, “এই নির্দেশনা শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নয়৷ যারা সরকারি অর্থ খরচ করবেন-মন্ত্রী, এমপি সবার জন্য৷ কারণ তারাই তো দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন৷’’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ‘‘এই অর্থবছরে সাশ্রয়ী হওয়া খুবই জরুরি৷ অর্থনীতির ওপর চাপ আছে৷ আর সরকারের রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক নয়, নিম্নমুখী৷ তাই সরকারকে অনেক জায়গায় খরচ কমাতে হবে৷ সরকারি চাকুরেদের এবার শতকরা পাঁচ ভাগ প্রণোদনা দিতে বছরে অতিরিক্ত আরো চার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে৷ এই টাকা আসবে কোথা থেকে?’’
তিনি মনে করেন আরো সাশ্রয়ের খাত বের করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘গত অর্থ বছরে প্রজেক্টগুলো এ, বি এবং সি তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো৷ সেখানে বলা হয়েছিলো সি ক্যাটাগরির প্রজেক্টগুলো অগ্রাধিকার পাবে না৷ এবার কিন্তু সেটা করা হয়নি৷ আমার মনে হয় এবারো কম গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টে অর্থায়ন বন্ধ রাখা উচিত৷’’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘‘গতবার সাশ্রয়ের আদেশ দেয়া হয়৷ কিন্তু তা কতটুকু হয়েছে তা স্পষ্ট নয়৷ তাই সরকারের উচিত এব্যাপারে তথ্য প্রকাশ করা৷ আর যে আদেশ দেয়া হয় তা রাজনীতির সঙ্গে আমলাতন্ত্রের সম্পর্কের কারণে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না৷ বাস্তবায়ন হওয়াটা জরুরি৷’’
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘‘দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে৷ কিন্তু আমাদের আরো এক বছর সাবধান থাকতে হবে৷ সেই কারণেই আগের বছরের সাশ্রয় নীতি এবারও অব্যাহত রাখা হয়েছে৷’’
কিন্তু এই নির্দেশনা যে ঠিকমত মানা হচ্ছে না তা তিনি স্বীকার করে বলেন, ‘‘এবার মানবে৷ কারণ আগের চেয়ে স্ট্রংগার ল্যাঙ্গুয়েজে বলা হয়েছে৷ আর সাশ্রয় কিছু হচ্ছে৷ আগে সচিবেরা সব সময় প্লেনেই থকতেন৷ এখন সেরকম নয়৷’’
তারপরও সাশ্রয়ের নির্দেশনা অনেকে মানতে চান না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এরা মানে না তো৷ এরা মনে করে যথা পূর্বং, তথা পরম৷
এসএইচ-০১/০৪/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)