বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সংকট নিরসন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের উপায় বের করতে ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণাসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাভাবে তাগিদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সফর করা মার্কিন প্রতিনিধিরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেননি। তবে এবার মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও ডোনাল্ড লু বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফর করলেও আলাদা করে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছেন না। তারা সরকারপ্রধান, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তবে উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলটি এবার বিএনপির সঙ্গে কথা বলবে। অবশ্য বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি এখনই প্রকাশ করতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। সেজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেয়নি ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, এ ব্যাপারে আপনারা কোথা থেকে কী শুনেছেন আমি জানি না। এ বিষয়ে আমার কাছে এখনো কোনো তথ্য নেই। আমি যতদূর জানি বা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে আমরা যেটা শুনতে পাচ্ছি, ওরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সেভাবে বৈঠক করবে না। আর যদি হয়েও থাকে সেটা আপনারা দেখতে পারবেন। তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।
চলতি বছরের শুরুতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করেছেন। পরের মাসে ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলেট ঢাকা সফর করেন। এর আগে, গত বছরের নভেম্বরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের উপ-সহকারী মন্ত্রী আফরিন আক্তার এবং একই বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের সফরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়নি।
চার দিনের সফরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছান মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। তার সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। যিনি কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন এবং ভিসা নীতি প্রণয়নে তার বিশেষ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার এশিয়া দপ্তরের উপ-সহকারী প্রশাসক অঞ্জলী কৌরও উজরা জেয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, উজরার সফরে ঢাকার পক্ষ থেকে শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অগ্রগতি, নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি, র্যাবের নিষেধাজ্ঞা ও রোহিঙ্গা সমস্যা মূল ফোকাসে থাকার আভাস রয়েছে। অন্যদিকে ওয়াশিংটন গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, শ্রম সমস্যা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মানবপাচারের মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার প্রতিনিধিদলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।
মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার মূল বৈঠকটি হবে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে। এছাড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি।
এর বাইরে মার্কিন দলটি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শ্রমিক নেতাসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশকে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির আন্ডার সেক্রেটারির ঢাকা সফরে তাই আলোচনার টেবিলে থাকবে নির্বাচন প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে ওয়াশিংটন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার প্রক্রিয়া ঢাকার কাছে জানতে চাইতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন প্রসঙ্গ আনবে। তবে নির্বাচন প্রসঙ্গে কোন বিষয়গুলো জানতে চায়, সে ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তারা কোনো তথ্য দেয়নি। তাছাড়া তারাও (যুক্তরাষ্ট্র) বুঝতে পারছে না নির্বাচন নিয়ে কী হতে যাচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মার্কিন দলটি নির্বাচন প্রসঙ্গ তুললে সরকারের সংশ্লিষ্টরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করবেন। এক্ষেত্রে সর্বশেষ দেশের যেসব সিটি করপোরেশনের নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার চিত্র তুলে ধরা হতে পারে।
উজরা জেয়ার ভারত ও বাংলাদেশ সফর নিয়ে গত শনিবার এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ৮ থেকে ১৪ জুলাই ভারত ও বাংলাদেশে সফর করবেন। তিনি বাংলাদেশে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার সময় রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট, শ্রম সমস্যা, মানবাধিকার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করবেন।
অবশ্য গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র-সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়। এ সফরের সময় অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। তার মধ্যে নির্বাচনের প্রসঙ্গও আসতে পারে।
মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করার বার্তা ঢাকাকে দিয়েছে ওয়াশিংটন। তবে রোহিঙ্গার আবরণে মূল আলোচনা হবে মানবপাচার ও শ্রম ইস্যুতে।
ঢাকার এক কূটনীতিক জানান, মার্কিন প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরেজমিনে দেখার পাশাপাশি হোটেলে কিছু রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ঢাকার পক্ষ থেকে ক্যাম্পেই রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎ নেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
মানবপাচার নিয়ে নির্দিষ্ট করে কোনো বার্তা না দিয়ে এ কূটনীতিক বলেন, বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের পাচার হওয়ার ঘটনা ঘটছে, এ বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যেতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা হবে।
শ্রম ইস্যু নিয়ে জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিক বলেন, শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরে চাপ দিয়ে আসছে। এবার সেটাকে আরও জোরালোভাবে তুলবে বলে আমরা মনে করি। কিন্তু শ্রম ইস্যুতে তাদের অবস্থান যে খুব শক্ত, সেটাও না। আমাদের এখানে তো ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তারা-তো ট্রেড ইউনিয়নও করতে দিচ্ছে না।
এ কূটনীতিক বলেন, রানা প্লাজার পর কিন্তু বাংলাদেশে শ্রম পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। শ্রম আইনের সংস্কার হয়েছে, ট্রেড ইউনিয়নে নিবন্ধন হচ্ছে- এসব উন্নতি আমরা তুলে ধরব।
তাছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) নিয়েও কথা বলবে ওয়াশিংটন। সেজন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে মার্কিন দলের বৈঠক রাখা হয়েছে। যেন আইনের বিষয়ে তিনি বিস্তারিত তুলে ধরতে পারেন। তবে ওয়াশিংটন আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটি রাখার বিষয়ে রাজি ছিল না।
ওয়াশিংটনের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, উজরার ঢাকা সফরে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) থেকে সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে।
ঈদুল আজহার আগে গাজীপুরের টঙ্গীতে শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলামকে হত্যা করা হয়। জানা গেছে, শহীদুলের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের দাবি জানাবে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি।
ইতিমধ্যে শহীদুল হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের লেবার ডিপার্টমেন্ট নিন্দা জানিয়েছে। পাশাপাশি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ৫ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যালয় পরিদর্শন করেন। ওই দিন মার্কিন দূতাবাসের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে পিটার হাসের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। তিনি বলেন, শহীদুল হত্যাকাণ্ডের মামলার তদন্তে সার্বক্ষণিক নজর থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের।
এ প্রসঙ্গে এক কূটনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনা অনেক দূর নিয়ে যাবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের লেবার ডিপার্টমেন্ট নিন্দা জানিয়েছে। উজরা জেয়াও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলবেন।
উল্লেখ্য, শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন।
এসএইচ-০৭/১২/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : ঢাকা পোষ্ট)