জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি একযুগের বেশি সময় ধরে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর থেকে এ অবস্থা চলছে। এ নিয়ে গত এক বছরে রাজপথে বিরোধীদের আন্দোলন, ক্ষমতাসীনদের পাল্টা কর্মসূচি, নানা বাগ্যুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে। এর মধ্যেই আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিস্থিতি কেমন হতে পারে- এ নিয়ে যখন সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা আশঙ্কা, জল্পনা-কল্পনা দানা বাঁধছে, তখন সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ সময়ে এসে রাজনীতিতে হঠাৎ করেই একটি ‘একদফার দেয়াল’ দাঁড়িয়ে গেছে।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টানা আন্দোলনের পরও দাবি না মানায় গত বুধবার সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এর বিপরীতে একই দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেকটা আচমকা ‘একদফা কর্মসূচি’
ঘোষণা দেয়, যাতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। ফলে বড় দুটি দলের এই বিপরীতমুখী অবস্থান কী বার্তা দিচ্ছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ সর্বত্র জোর আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। এতে নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, সমঝোতাই হতে পারে শেষ সমাধান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিনের মতবিরোধ ও দূরত্ব কমাতে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগোতে হবে দুপক্ষকেই। তা না হলে সংকটের সমাধান একদফায়ই বন্দি থেকে যাবে, যা রাজনীতিতে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমার মনে হয় রাজনীতিকে নির্বাচনের দিকেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যখন নির্বাচনমুখী হয় দুটি দল, তখন নানা ধরনের দাবি, পাল্টাদাবি উপস্থাপিত হয়। এখন সেই প্রক্রিয়াটা চলছে। মাঝখানে আবার বিদেশি দল আসছে। তাদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন চলছে। সবকিছু মিলে আমার মনে হয়, দেশ পুরোপুরি নির্বাচনমুখী। সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে, এটাই শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে।’
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো একদফা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ বলেছে, তাদেরও একদফা, শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি এই অবস্থান প্রসঙ্গে সুশানের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, উভয় রাজনৈতিক দল যদি এই একদফা দাবিতে অনড় থাকে, তাহলে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। আর সমঝোতার সুযোগ না থাকলে রাজনৈতিক উত্তেজনা, সহিংসতা সেই দিকেই যেতে পারে। আশা করি, ওই দিকে আমরা যাব না। ওই দিকে গেলে কেউই লাভবান হবে না, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আশা করি, সব পক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাবে এবং সমঝোতাই হচ্ছে সমাধানের পথ।
গত বুধবার রাজধানীতে বড় দুই দলের সমাবেশ প্রসঙ্গে সুজন সম্পাদক বলেন, এবারের সমাবেশ সহিংস ছিল না। অতীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হতো, সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী দলের সংঘর্ষ হতো। এবার পুলিশও বাড়াবাড়ি করেনি, সরকারি দলের দিক থেকেও কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। এর মূল কারণ হয়তো বিদেশিরা এই শহরে। বিদেশিদের নাগের ডগায় এই সমাবেশ হচ্ছে। তারা যদি না থাকে, তাহলে এই পরিবেশ থাকবে কিনা সেটা দেখার বিষয়।
২০১১ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়। এরপর থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশের রাজনীতিতে বিরোধ চলছে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে না হওয়ায় ভোট বর্জন করে বিএনপি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করে। তবে ওই ভোটের কারচুপির অভিযোগ আনে। দলটি তখন বলেছিল, নির্দলীয় সরকারের অধীনে তারা যে নির্বাচনের দাবি করে আসছেন তা যৌক্তিক। দলীয় সরকারের অধীনে ভোট হওয়ায় ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলেও দলটির পক্ষ উল্লেখ করা হয়।
আওয়ামী লীগের অবস্থান : আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য, তারা যে একদফার কথা বলছেন তা হলো সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নির্বাচন করা। সংবিধান পরিপন্থি কোনো অবৈধ পদ্ধতিকে তারা মেনে নেবেন না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এটাও দুদলের নির্বাচনমুখী হওয়ার বিষয়টিই স্পষ্ট করে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের তো দফা একটাই যে, সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচন হওয়া। কাজেই এই দফা তো কোনো দলীয় দফা না। এটা আমাদের সংবিধানের দফা। রাষ্ট্রযন্ত্র সংবিধানকে সব সময় সমুন্নত রাখে, সম্মান করে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটা বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী এবং সংবিধানসম্মতভাবে করা- এটাই হলো এই দেশের জনগণের একদফা। সুতরাং এই কথার বিপরীতে অর্থাৎ পাল্টাপাল্টির প্রশ্ন ওঠাই উচিত না।’
বিএনপির একদফার মূল্যায়ন জানতে চাইলে আবদুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি বাঁকাপথে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না।।
একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে দুদল বিরোধী অবস্থানে। ওয়েট অ্যান্ড সি। এখনই বলা যাচ্ছে না। যে যার অবস্থানে স্থির আছে। রাজনীতি কোথায় নিয়ে যায় তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ’
বিএনপির অবস্থান : বিএনপি নেতারা বলেন, গত বছর ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠ থেকে ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। সেই আন্দোলনকে সমর্থন জানায় সমমনা ৩৭ রাজনৈতিক দল, জোট ও সংগঠন। এর মধ্যে নানা কর্মসূচি করে করে বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো সাত মাসের ব্যবধানে একদফা কর্মসূচি ঘোষণা দেয়।
গত বুধবার রাজধানী ঢাকার ১৩ স্থান থেকে একযোগে একদফা ঘোষণা করতে পারাকে আন্দোলনের বড় ধরনের সফলতা হিসেবে দেখছেন বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতারা। বিশেষ করে দুই-তিন দিনের নোটিশে রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনে বড় পরিসরে ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে পারায় বিএনপির শীর্ষনেতারাও বেশ খুশি।
এই খুশির কারণ হিসেবে বিরোধী নেতারা বলেন, এই সমাবেশ ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ; যেখানে নানা শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সমাবেশটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে। আন্দোলনের একদফা এবং রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা ঘোষণা করা নিয়ে বেশকিছু দিন ধরে জটিলতা ছিল। কিন্তু পরিকল্পনামাফিক একযোগে ৩৭ রাজনৈতিক দলকে দিয়ে তা ঘোষণা দেওয়াও সম্ভব হয়েছে। আবার কৌশলে জামায়াতে ইসলামীকে দূরে রাখা গেছে। বিএনপি ও সমমনা নেতাদের ভাষ্য- এবার তাদের আন্দোলন বৃথা যাবে না, বিজয় হবেই। এ বিষয়ে গত বুধবার নয়াপল্টনের সমাবেশেও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একদফা ঘোষণা করে বলেন, বিজয় আমাদের হবেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, একদফার আন্দোলনের প্রথম দিনের সূচনাতে প্রমাণিত হয়েছে- জাতি এখন একদফায় ঐক্যবদ্ধ। শেখ হাসিনার অধীনে আর কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না। ফলে বিরোধী দলের ঘোষিত একদফা দাবি শেখ হাসিনা মানতে বাধ্য হবেন। আওয়ামী লীগের একদফা প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বিএনপির দাবি জনগণের দাবি। তারা যে দাবি করছে অর্থাৎ শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন, তা এ দেশে আর হবে না। তারা অতীতের মতো রাজপথে কোনো সহিংসতাও সৃষ্টি করতে পারবে না। কারণ, তাদের সেই লগি-বৈঠার দিন শেষ।
বিএনপির সমমনা রাজনৈতিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষনেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না আমাদের সময়কে বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে আর কোনো নির্বাচনে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল অংশ নেবে না। আমরা একদফা ঘোষণা করেছি। এই দাবি আদায় করেই ঘরে ফিরব।
এসএইচ-০২/১৪/২৩ (অনলাইন ডেস্ক)