নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে তৈরি হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট। পরে তত্ত্বাবধায়ক কায়েম হলে সেটিকে পচানোর সব ব্যবস্থাও করে দলটি। এখন আবার সেই তত্ত্বাবধায়কের দাবি তুলে শুরু করেছে আন্দোলন, ঘোষণা দেয়া হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন বর্জনেরও। যদিও বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বলছেন, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ এখনও খোলা আছে।
১৯৯১ সালে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-২ আসনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান। ৯৩’র দিকে তার মৃত্যু হলে আসনটি শূন্য হয়। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ এই আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আসাদুজ্জামানের ছেলে শফিকুজ্জামান বাচ্চু। আর বিএনপির প্রার্থী হন সলিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল।
সেই নির্বাচনে কারচুপির সবমাত্রা ছাড়িয়ে যায়। একটি হোন্ডা (মোটরসাইকেল), তিনটি গুণ্ডা হলে নির্বাচনে জয় সম্ভব- এমন স্লোগান নিয়ে মাঠে নামেন বিএনপি নেতারা। উপনির্বাচন পর্যবেক্ষণে গিয়ে হেলিকপ্টারে ফিরে আসতে বাধ্য হন তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ।
২১ মার্চ মাগুরা থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের ভোট-ভাতের অধিকার আদয়ের ঘোষণা দেন। শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন।
সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের দাবিতে জামায়াত সমর্থিত তৎকালীন বিএনপি সরকার কান দেয়নি। বরং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন অব্যাহত রাখলে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে পদত্যাগে বাধ্য হয় সরকার।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মতে, ১৯৯৬ সালের বাস্তবতা আর ২০২৩ এর বাস্তবতা এক নয়। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো বিএনপি আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নিরপেক্ষ সরকার চাইছে।
তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে বা আওয়ামী লীগ, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো, বিএনপি কিন্তু তা পারছে না। ওই সময় মার্কিন প্রতিনিধি দল গ্যারান্টর হয়েছিল যে, যারা ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছেন তাদের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু আজকে এতো বছর পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওইরকম গ্যারান্টর অনুপস্থিত। এটি সংকটের একটি বড় কারণ।’
১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২১ বছর পর সরকার পরিচালনায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছর পর তারা বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। লতিফুর রহমান প্রধান উপদেষ্টা হয়েই বদলি করে দেন ১৩ জন সচিবকে। শেরে বাংলা নগরে জনসভা শেষ করে গণভবনে গিয়েই শেখ হাসিনা দেখতে পান, কেটে দেয়া হয়েছে টেলিফোন লাইন। অথচ তখনো প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্তই হননি।
২০০১ সাল। ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। মেয়াদ শেষের দিকে এসে শুরু হয় সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ। সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করা, বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করার তোড়জোড়। ২০০৪ সালের ১৬ মে সংসদে সংবিধানের সংশোধনী বিলটি উত্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সাদামাটা বিষয়ে কেন সংবিধান সংশোধনী, প্রশ্ন উঠতে থাকে বিভিন্ন মহলে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অনুযায়ী, সবশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। অভিযোগ ওঠে শুধুমাত্র বিএনপির পছন্দমত ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতেই বাড়ানো হয় বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা।
২০০৩ সালের জুন মাস। প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে তাকে করা হয় দেশের ১৩তম প্রধান বিচারপতি। কে এম হাসান একসময় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য। যেন কে এম হাসান অবসরের পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন।
এর ফাঁকে নতুন ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটার তৈরি এবং বিতর্কিত বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার। এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে তৎকালীন সংসদের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সবকিছু তোয়াক্কা না করে বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছিলো তাদের পরিকল্পনামাফিক। এক পর্যায়ে প্রবল আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান কে এম হাসান। শুরু হয় নতুন বিতর্ক।
সংবিধান অনুযায়ী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব না নিলে আগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। এছাড়াও চারটি বিকল্প ছিলো সংবিধানে। এর সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের পাশাপাশি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। দায়িত্ব নেয়ার পর ইয়াজউদ্দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। পদত্যাগ করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চার উপদেষ্টা। শুরু হয় নতুন সংকট।
সবকিছু উপেক্ষা করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন ইয়াজউদ্দিন। রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়তে বাধ্য হন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। দৃশ্যপটে সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে গঠিত হয় আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে।
তিন মাসের জন্য দায়িত্ব নিয়ে সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকে প্রায় ২ বছর। চলতে থাকে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া এবং দুই নেত্রীকে মাইনাস করার নানা ষড়যন্ত্র। দুর্নীতির মামলা দিয়ে প্রথমে জেলে পাঠানো হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। এরপর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঠানো হয় কারাগারে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। হাইকোর্টে ওঠে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল চেয়ে করা রিট। হাইকোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চের দুইজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত দিলেও, ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হয় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা।
বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক বশির আহমেদ। তার মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের জন্য আসে। কিন্তু সেখানে গণপ্রতিনিধিত্ব থাকে না। তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা জনগণের পক্ষে থাকে না। দেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। ফলে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়া ভালো কিছু হবে না।
তিনি বলেন, সবাই একটা ভালো নির্বাচন চায়। এখন বিএনপি চাইলে সরকারের সাথে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু বিএনপি একের পর এক নির্বাচন বর্জন করে যাচ্ছে। কোন গণতান্ত্রিক দেশেই এমন সিস্টেম নেই। ভারতসহ অনেক দেশেই যখন নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করা হয় তখন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সব হয়। সেখানে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়। বাংলাদেশের আইনেও তাই আছে। সবশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে একটি ভালো নির্বাচনের উদাহরণ হিসেবে দেখতে চান এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
প্রথমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তত্ত্বাবধায়কের বিরোধিতা করেছিলো বিএনপি। পরে কারচুপি করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের কব্জায় নেয়ার অপচেষ্টা করেছিলো দলটি। তার ফলাফল যে সুখের হয়নি নিজেদের জন্য, বর্তমান বাস্তবতা সে কথাই বলছে।
বিএনপিকে দল হিসেবে ‘বিভ্রান্তিকর’ মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সময়ের সাথে সাথে দাবি-দাওয়া বা আন্দোলনের রূপরেখা কমিয়ে আনে। আর বিএনপি কখনো ১০ দফা, কখনো ২৭ দফা, সেখান থেকে এক দফা। আবার সেখান থেকে ৩১ দফায় গেছে। যে দল নিজেরাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তারা নিজেদের বিতর্কিত করা দাবিতে আবার ফিরে যাবে এটা অস্বাভাবিক না।
তাই বিএনপিকে স্থিতিশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, বিএনপিকে নিজেদের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য স্থিতিশীল হতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে যে কোন বিষয়ে সমাধান আসে। আমি আশা করবো আলোচনার মাধ্যমে একটি সুন্দর নির্বাচন হবে।
এসএইচ-০৭/১৪/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র :সময়)