জামায়াত কোন পথে এগুতে চাইছে

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামী, যার লক্ষ্য আপাতত রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃশ্যমান থেকে সরকার বিরোধী কর্মসূচি পালন করা – যাতে করে নির্বাচনের আগে ভোটের মাঠের জন্য দলকে প্রস্তুত করে তোলা যায়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের সাজা, প্রকাশ্য রাজনীতিতে দীর্ঘ অনুপস্থিতি, নিবন্ধন বাতিল এবং সরকারের নানামুখী চাপে থাকার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অবস্থান আছে দলটির।

গত প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দলটি নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে কখনো বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের সাথে এক ধরনের বোঝাপড়া করে রাজনীতি করে আসছে।

আদালতের একটি রায়ের ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছিলো।

তবে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে আবার সক্রিয় হওয়া দলটির নেতারা আশা করছেন, নির্বাচন নিয়ে সব পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলে এবং সবাই তাতে অংশ নেয়ার পরিবেশ তৈরি হলে তারাও তাদের নিবন্ধন ফেরত পাবেন আইনি প্রক্রিয়াতেই।

দলের নেতারা বলছেন, এখন দলকে রাজনীতির মাঠে চাঙ্গা ও দৃশ্যমান করাই তাদের মূল লক্ষ্য। আর এর মাধ্যমেই তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের অবস্থানও জোরদার করতে চান।

“আমরা সবসময়ই বলছি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা লাগবে। বর্তমান সরকার বিদায় নিলেই জামায়াতের বিরুদ্ধে নেয়া সব বেআইনি পদক্ষেপের প্রতিকার পাবো। সে কারণে আমরাও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে সোচ্চার হবো,” – বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন দলটির একজন মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে জামায়াত ইসলামী রাজনৈতিকভাবে কার্যত কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। এরপর নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবার পর কোন নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি দলটি।

এর মধ্যেই তাদের দীর্ঘকালের জোট সঙ্গী বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকেও সরে যেতে হয়েছে জামায়াতকে।

যদিও এটি বিএনপিকে জামায়াত-বিতর্ক থেকে স্বস্তি দেয়ার কোন কৌশল কিনা – তা নিয়ে জোর আলোচনা আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

তবে এসব কিছুকে ছাপিয়ে গত প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিষ্ক্রিয় থাকার পর গত দশই জুন ঢাকায় সমাবেশ করে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় দলটি।

বিশেষ করে হঠাৎই কর্তৃপক্ষ সমাবেশের জন্য দলটিকে অনুমতি দেয়ায় এ নিয়ে নানা ধরণের তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে।

কারণ এর আগে পুলিশ যেমন দলটিকে কোথাও কোন কর্মসূচি পালন করতে দেয়নি, তেমনি পুলিশের বাধার কারণে এর কর্মী সমর্থকরাও প্রকাশ্যে কোথাও বৈঠকেরও সুযোগ পাননি।

আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই বহুবার দলটিকে নিষিদ্ধ করে আইন করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

সেই দলটি একটি প্রতিনিধি দল যখন সমাবেশের জন্য পুলিশ কমিশনারের অফিসে যান – তখনই এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সাথে সাথে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর বক্তব্যও মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে।

যদিও ঢাকার সমাবেশের পর আজ শনিবারে সিলেটে যে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছিলো জামায়াতে সেটিতে ‘নাশকতার আশঙ্কা’ দেখিয়ে সায় দেয়নি স্থানীয় পুলিশ।

“পুলিশ নাশকতার কথা বলছে অথচ গত কয়েকদিন আমরা যে প্রচার সেখানে করেছি তাতে কিন্তু অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে অনুমতি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দেশের সর্বত্রই সমাবেশের কর্মসূচি সফলের চেষ্টা আমাদের থাকবে,” বলছিলেন মতিউর রহমান আকন্দ।

দলটির আরও কয়েকজন নেতা এবং সিনিয়র কয়েকজন নেতার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে সম্প্রতি নির্বাচনকে সামনে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জামায়াত নেতারা।

এই নীতির আওতায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিংকেন ঘোসণা দিয়েছিলেন, যে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি সেদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় – তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতি অনুযায়ী নতুন এ নীতির আওতায় পড়বেন বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার-সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারবিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা।

মূলত সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে মার্কিন এ নীতি চাপে ফেলায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন সহজ হবে বলে মনে করেছেন দলটির নেতারা।

যদিও সরকারের একটি অংশের সাথে যোগসাজশেই জামায়াত মাঠে নেমেছে এমন প্রচারণাও আছে, যা আওয়ামী লীগ ও জামায়াত উভয়েই প্রত্যাখ্যান করেছে।

বরং দশই জুনের সমাবেশে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহের বলেছেন আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হবে।

“আওয়ামী লীগের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এদের হাতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিরাপদ নয়,” বলছিলেন তিনি।

জামায়াত মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলছেন, এখন সামনের দিনগুলোতে তারা এসব বক্তব্য নিয়েই জনমত সংগঠন করবেন – যার মূল উদ্দেশ্যই থাকবে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করা।

“সরকারকে বিদায় করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে পারলে আমাদের নিবন্ধন, দল, জোট, নির্বাচনসহ সব কিছু নিয়েই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো” – বলেন তিনি।

অর্থাৎ জামায়াত চাইছে নিজেদের তৎপরতা দৃশ্যমান করতে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটসহ বিরোধী দলগুলো সরকারবিরোধী যে আন্দোলনের সূচনা করেছে – সেখানে নিজ অবস্থানে থেকে সামিল হতে, যাতে করে জামায়াতও নিজেদের অবস্থান ধরে রেখে নিবন্ধন আদায় করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে নিতে পারে।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক দলটির মধ্যম পর্যায়ের একজন নেতা বলেছেন, “সরকার এখন ব্যাকফুটে। জামায়াতের ঘুরে দাঁড়ানোর এটাই সময়।”

“প্রথমে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে চাইলেও এখন আর জামায়াতের ওপর চড়াও হতে পারবে না সরকার। তাই এখনই নামতে হবে ও নির্বাচনের মাঠ গুছাতে হবে, যাতে ভোটে ও জোটে শক্ত ভূমিকা নেয়া যায়” – বলেন তিনি।

তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী এবারের ঈদের সময়ে দলটির সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা নিজের নির্বাচনী এলাকায় গেছেন এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণায় অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন।

এসব প্রার্থীরা সামাজিক মাধ্যমেও এলাকা ভিত্তিক তাদের কার্যক্রম তুলে ধরেছেন।

এই নেতা যখন বিবিসির সাথে কথা বলছিলেন তখন ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করছিলো দলটির নেতারা।

তার মতে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণ ততই আরও নিবিড় হবে বলে মনে করছেন তারা।

সে কারণেই নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে শক্ত অবস্থান তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েই তারা এখন এগুতে চান। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আসবে দলের পক্ষ থেকে।

পাশাপাশি দলীয় কার্যক্রমও চাঙ্গা করার চেষ্টা হবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে।

এসএইচ-১০/১৫/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : বিবিসি)