ঢাকার গাবতলীতে গত মঙ্গলবার যখন বিএনপি’র পদযাত্রা কর্মসূচি শুরু হচ্ছিল, ঠিক তখনি সমাবেশের অদূরে প্রায় শ’খানেক শ্রমিকের একটি দল একত্রিত হচ্ছিলেন। তারা সবাই এসেছেন ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে, বিএনপি’র অঙ্গসংগঠন শ্রমিক দলের হয়ে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, নিকট অতীতে এই প্রথম তারা নিজ এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশে এসেছেন।
শ্রমিক দলটির আহবায়ক আহসান পিন্টু বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা এলাকায় থাকতেই পারতাম না। মিছিল তো দূরের কথা। পুলিশ আছে, আওয়ামী লীগের লোকজন আছে। মিছিলের চেষ্টা করলেই হামলা হতো।”
আহসান বলছেন, এবার তারা এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে এসেছেন। কেউই বাধা দেয়নি।
“আগে যেমন পুলিশের একটা হয়রানি ছিলো, এখন বিদেশি চাপে হোক বা জনগনের চাপে হোক সেটা নাই। আমরা নিজেরাও আর ভয় করিনা। ঘরে থাকলেও মামলা, আন্দোলন করলেও মামলা। সুতরাং আমরা এখন থেকে এভাবেই আন্দোলনে অংশ নেবো।”
আহসান সরকারের উপর বিদেশি যে চাপের কথা বলছেন, বাংলাদেশে সেটা গেলো একবছরে বেশ স্পষ্ট হয়েছে। আর এই একই সময়ে বিএনপি’ও রাজপথে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
দুটি মিলিয়ে রাজনীতিতে এমন একটা আলোচনা আছে যে, বিএনপি’র আন্দোলন অনেকাংশেই বিদেশি শক্তিগুলোর চাপের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং বিদেশী চাপ যদি এভাবে সরকারের উপর অব্যাহত না থাকে তাহলে বিএনপি’র আন্দোলন খুব একটা সফল হবে না।
ক্ষমতাসীন দলের উপর প্রথমবারের মতো বিদেশি চাপ দৃশ্যমান হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে। সে সময় মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে র্যাবের ছয় কর্মকর্তার উপর স্যাংশন দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি সরকারকে বেশ নাড়া দিয়েছিলো।
তার পরের বছরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে সরকার বিরোধী শক্ত কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারা দলটির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে ব্যাপক লোকসমাগম দেখা যায়। এরমধ্যেই গেলো মে মাসে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে মার্কিন সরকার।
মূলত: মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। আর সেই সুষ্ঠু নির্বাচন যারা বাধাগ্রস্ত করবে তাদের ও স্বজনদের ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয় ভিসা নীতিতে।
এই ভিসা নীতি ঘোষণার দুই মাসের মধ্যেই সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি। মূলত: র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞার পর ভিসা নীতি এবং বিদেশি চাপে সরকার নমনীয় হওয়ায় বিএনপি বড় আন্দোলনে যেতে পারছে এমন আলোচনা আছে রাজনীতিতে। একই সঙ্গে পশ্চিমা চাপ না থাকলে বিএনপি কতটা মাঠে সুবিধা করতে পারবে তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। যদিও বিএনপি বলছে, পশ্চিমা চাপ নয়, তাদের শক্তি জনগন।
দলটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, যখন আইন-শৃংখলা বাহিনী কর্মীদের উপর গুলি করা বন্ধ করে তখন এটা বিএনপি’র জন্য সুবিধাজনক তো বটেই। কিন্তু বিএনপি’র আন্দোলন এসবের উপর নির্ভরশীল নয়।
একই কথা বলছেন, দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
“বিদেশি চাপ নিশ্চয়ই কর্মীদের উৎসাহিত করে। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু সেটার উপর আমাদের নির্ভরশীল নই। আমরা গুরুত্ব দিচ্ছে জনগনের শক্তিকে একত্রিত করার উপর।”
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় পশ্চিমাদেশগুলোর তেমন কোন চাপ না থাকলেও এবারের নির্বাচনের বেশ আগেই পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা একের পর এক আসছেন ঢাকা সফরে।
এরমধ্যে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বড় ধরণের সফর হয়েছে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া নেতৃত্বে। সফরে মার্কিন এই প্রতিনিধি দলের বক্তব্য কী হয় তা নিয়ে আগ্রহ ছিলো আওয়ামীলীগ-বিএনপি দুই দলের মধ্যেই
তবে সফরে আসা দলটি বিএনপিসহ বিরোধী কোন দলের সঙ্গেই যেমন দেখা করেনি, তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা সংলাপ নিয়েও চাপ সৃষ্টি করেনি সরকারের উপর। ফলে এই সফর নিয়ে বিএনপি’র তরফে খুব একটা উচ্চবাচ্চ্য নেই।
অন্যদিকে, বিএনপি’র দাবি কেউ শুনছে না এমন বক্তব্য এনে বিএনপিকে কটাক্ষ করছে আওয়ামী লীগও। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তার ভাষায় “আমেরিকানরা বিএনপিকে দিয়েছে ঘোড়ার ডিম।”
তবে বিএনপি’র মূল্যায়ন ভিন্ন। দলটির সূত্রগুলো বলছে, উজরা জেয়ার সফরে মার্কিন প্রতিনিধি দল কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই বৈঠক করেনি। তাদের বৈঠক হয়েছে সরকারের সঙ্গে।
কিন্তু মার্কিন এই দলটি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি’র দাবির বিষয়ে কোন কিছু বলেনি, সেটা বিএনপি’র জন্য কতটা হতাশাজনক?
এমন প্রশ্নে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, এখানে হতাশার কোন প্রশ্নই নেই। কারণ মার্কিন প্রতিনিধিদল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামীলীগ সরকারকে চাপ দেবে এমন আশা বিএনপি করেনি। তিনি বলছেন,
“বিদেশি রাষ্টগুলো কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলবে? ওরা তো কোন সময়ই এটা বলেনি। আমরাও এটা প্রত্যাশা করিনি। এটা তো তারা বাইরে থেকে এসে বলবে না যে, কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু তারা স্পষ্ট করে এটা বলেছে, আন্তর্জাতিক মানের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা। বাংলাদেশে কিন্তু এমন নির্বাচন হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই।”
বিএনপি মনে করছে, মার্কিন প্রতিনিধিদল সফরে এসেছে মূলত: সরকারের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে। কূটনৈতিকভাবে তাদের যা বলার সেটা তারা সরকারকেই বলে দিয়েছে। সুতরাং সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ এখন সরকারকেই নিতে হবে। এর সঙ্গে বিএনপি কী অর্জন করলো, না করলো তার কোন সম্পর্ক নেই।
দলটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলছেন, মিডিয়ার সামনে যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য তারা দিয়েছেন, ঠিক সেটাই যে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই।
“আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, তাদের (মার্কিন প্রতিনিধিদল) সকল বার্তাই ছিলো সরকারকে উদ্দেশ্য করে। কারণ তারা জানে বাংলাদেশের মাটিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হবার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। সে কারণেই তারা বিশ ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে আমেরিকা থেকে এ দেশে উড়ে এসেছে।”
বিদেশিদের ভূমিকা যেমনই হোক, বিএনপি যে সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে এতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানোর মতো শক্তি বিএনপি’র আছে কি-না সেটা সংশয় আছে অনেকেরই।
নির্বাচনের যখন আর ছয় মাসের মতো সময় বাকি আছে তখন পদযাত্রার পর বিএনপি’র পরবর্তী কর্ম-কৌশলই বা কী হবে সেটা নিয়েও আছে আলোচনা।
তবে বিএনপি বলছে, সরকার বিরোধী সব দলকে নিয়ে তাদের কর্মসূচিতে এখন জনসম্পৃক্ততা আরো বাড়ানোই মূল লক্ষ্য। চূড়ান্ত আন্দোলন আসবে ধাপে ধাপে, পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।
“তীব্র আন্দোলন কখনো ছয় মাস ধরে হয় না। তীব্র আন্দোলন কয়েকদিনের হয়। সেই তীব্র আন্দোলনের জন্য যা করা দরকার সেটাই আমরা এখন করছি।” বলছিলেন রুমিন ফারহানা।
বিএনপি আপাতত: জোর দিচ্ছে রাজপথে ধারাবাহিক উপস্থিতির উপর। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে আসছে পাল্টা কর্মসূচি। দুই পক্ষের এমন কর্মসূচি কোথাও কোথাও সংঘাতেরও জন্ম দিচ্ছে।
বিএনপি একদফা’র আন্দোলন কিভাবে এগিয়ে নেবে, সরকারই বা সেটাকে কিভাবে মোকাবেলা করবে এবং বাংলাদেশের উপর বিদেশি চাপ শেষপর্যন্ত কোন রূপ নেবে -এমনসব প্রশ্নের যখন নির্দিষ্ট উত্তর নেই তখন দুই দলের মধ্যে আলোচনার অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করবে বলেই মনে হচ্ছে।
এসএইচ-০২/২১/২৩ (তাফসীর বাবু,বিবিসি)