বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শ্রীলংকাও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে, যা বাংলাদেশ পারেনি। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ভূমিকা, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজারে মূল্য কারসাজির প্রবণতা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকিতে ব্যর্থতার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
“২০২২ সালে যখন দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে যায় তখন টাকার বড় ধরণের অবমূল্যায়ন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তখন যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে তার অনেকগুলোর দাম আর কমেনি,” বলছিলেন অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান।
সাধারণভাবে মূল্যস্ফীতি হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া, অর্থাৎ আগের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে এখন একই পণ্য বা সেবা কিনতে হচ্ছে। বাজারে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায় কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। আর এই মুদ্রাস্ফীতির ফলেই মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে।
করোনা মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ২০২২ সালের শুরুর দিকে সব দেশেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যায়। তখন বিশ্ববাজারে খাদ্য পণ্যের দাম ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিলো।
কোভিডে নাগরিকদের বড় ধরণের প্রণোদনা দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়ার রেকর্ড গড়েছিলো এবং সেখানে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে সাত শতাংশে ঠেকেছিলো তখন।
আর ব্রিটেনের পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে জ্বালানি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া নিয়ে বিক্ষোভও করেছিলো সেখানকার মানুষ।
ইউরোজোনে যে উনিশটি দেশে ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করা হয় সেসব দেশে গত বছর জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিলো পাঁচ শতাংশের বেশি, যা ২৩ বছর আগে ইউরো চালুর পর সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে বাংলাদেশে সরকারি হিসেবে ২০২২ সালের অগাস্টে মূল্যস্ফীতি প্রায় দশ শতাংশের ঘরে পৌঁছেছিলো, যা তার আগের এগার বছরেও হয়নি। চলতি বছরের জুনেও মূল্যস্ফীতি দশ শতাংশের কাছেই ছিলো।
যদিও স্বাধীন গবেষণা সংস্থাগুলো তখনি বলেছিলো যে দেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেশি। মূলত তখন থেকেই বিশ্বের নানা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে।
মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্বের অনেক দেশেই এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এসেছে, যার মধ্যে আছে ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকাও।
অন্যদিকে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তির দিকেই।
এমনকি চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবারো প্রায় দশ শতাংশের কাছে (৯দশমিক শতাংশ) উঠে যায়। এর আগে এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ছিলো ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
অথচ বিশ্ববাজারে কৃষি ও শস্যজাতীয় খাদ্যের দাম কমেছে। এমনকি খাদ্য উৎপাদন হয় এমন দেশগুলোতে ভালো আবহাওয়া এবং বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে আসার কারণেও খাদ্য মূল্য কিছুটা পড়তির দিকে।
কিন্তু তার পরেও বাংলাদেশ খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার যুদ্ধটাই শুরু করেনি, বরং তাদের কিছু পদক্ষেপ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে।
“তারা ডলার সংকট মোকাবেলায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এগুলো সব ধরণের পণ্য আমদানিতেই প্রভাব ফেলেছে।
তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আমদানি কমানো। কিন্তু এটি করতে গিয়ে খাদ্যপণ্যের যোগান কমে গেছে। সে কারণে স্থানীয় বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত যে কোন দেশের স্থানীয় বাজারের অনেক খাদ্য পণ্যের মূল্যই আন্তর্জাতিক বাজারেরে সাথে সম্পর্কিত। বিশেষ করে আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে এর প্রভাব বেশি হয়ে থাকে।
তবে ২০২১-২২ অর্থ বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। যার প্রভাবে বাংলাদেশেও খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়।
কিন্তু এসব পণ্যের দাম যখন কমা শুরু হয় তার আর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়েনি, বলছিলেন মি. হোসেন।
তার মতে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমাতে যে বড় অস্ত্র ব্যবহার করেছে সেটি হলো সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে, কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি।
“তাছাড়া এখানে বাজারে কারসাজির প্রবণতা আছে যা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ঠেকাতে পারছে না। আবার মার্কেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরণের সমস্যা আছে। বিশেষ করে চিনি, তেল, চাল ও পেয়াজের মতো ক্রিটিক্যাল পণ্যের দাম হুট করে হু হু করে বেড়ে যায় যার, সাথে চাহিদার কোনো সম্পর্কই নেই। এসব কারণেই দাম অনেক বাড়ার পর আর কমে না,” বলছিলেন জাহিদ হোসেন।
তার সঙ্গে একমত মুস্তাফিজুর রহমানও। তিনি বলেন মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা জরুরি। অর্থাৎ উৎপাদন, চাহিদা, ঘাটতি, আমদানি কোন পর্যন্ত করতে হবে, কখন দরকার- এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করে নীতি নির্ধারকরা কোথায় কখন কোন পণ্যের ঘাটতি হবে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
“আবার বাজারে যে নজরদারি দরকার সেটা না থাকায় যেসব পণ্য উৎপাদক ও আমদানিকারক কম সেখানে দাম অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে এটা দেখা গেছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এসব ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখেনি বলেই বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি,” বলছিলেন মি. রহমান।
তবে চলতি বছরের বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে এবার তার মূল্য লক্ষ্যই হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
অর্থনীতিবিদরা আগের বছর বা মাসের সঙ্গে অথবা কোন নির্দিষ্ট সময়কালের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য, কাপড়, পোশাক, বাড়ি, সেবা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানের মূল্য বৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করেন সেটাই মূল্যস্ফীতি।
অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি দিয়ে যেটা বোঝা যায় তা হলো, কোন একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে পরবর্তী আরেকটি সময়ে দাম কেমন বেড়েছে?
যেমন ধরুন একটা জিনিসের দাম ২০২০ সালে ছিল ৫ টাকা, পরবর্তী বছর তা হয়েছে ৬ টাকা। এভাবে বিভিন্ন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির তথ্য একটি পদ্ধতির মাধ্যমে গড় করে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।”
কয়েকভাবে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০২১ সালের ১৫ই জুলাই মূল্য কী ছিল আর এই বছরের ১৫ই জুলাই কী মূল্য আছে – এই দুইয়ের শতকরা ব্যবধান।
আরেকটি হচ্ছে, এক বছরে জিনিসপত্রের গড় মূল্য আর পরের বছরের ১২ মাসে গড় মূল্যের তুলনা করেও মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।
তবে বাংলাদেশে সরকারিভাবে মূল্যস্ফীতির যে তথ্য দেয়া হয় তাতে মূল্যস্ফীতি কম করে দেখানো হয় বলে গবেষণা সংস্থাগুলো নানা সময় অভিযোগ করেছে।
এসএইচ-০২/২২/২৩ (রাকিব হাসনাত,বিবিসি)