রাজনৈতিকভাবে একে অন্যকে চাপে ফেলতে নানামুখী কৌশল নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি। দুই দলেরই মূল লক্ষ্য এখন রাজপথ। বড় জমায়েতসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে ক্ষমতাসীনদের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে করে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কৌশলের কাছে বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
২৯ জুলাই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে বলেও মনে করে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, ক্ষমতাসীনেরা যে হামলা-মামলা ও ভয়ভীতি দেখানোর বাইরে যেতে পারছে না, সেটি শনিবারের অবস্থান কর্মসূচি প্রমাণ করে দিয়েছে।
আগামী নির্বাচনের আগে এক দফার আন্দোলনকে নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে দেখছে বিএনপি। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব না হলে আওয়ামী লীগ অস্তিত্বের সংকটে পড়বে বলে দলটির নেতারা মনে করছেন। ফলে দুই পক্ষই তাদের নিজ নিজ অস্তিত্বের সংকট মোকাবিলায় অনমনীয়।
জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে দুই পক্ষই রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজ নিজ কৌশলে জয়ী হতে চাইছে। এ রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া শঙ্কা, অনিশ্চয়তাকে কতটা বিবেচনায় নিচ্ছে দুই দল—সেই প্রশ্ন উঠেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি কীভাবে এগোয়, সেটা নজরে রেখেই আমরা কৌশল নিচ্ছি।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, গত ২৯ জুলাই শনিবার ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে দলটির এক দফার আন্দোলন হোঁচট খেয়েছে। এই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের আরও উজ্জীবিত করেছে।
ঢাকায় মহাসমাবেশে বড় জমায়েত করার পর ২৯ জুলাই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে উপস্থিতি ছিল নগণ্য। এই অবস্থান কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতার অভাবসহ নানা ঘাটতির বিষয়ে দলটির ভেতরেও নানা আলোচনা চলছে। এরপর দলটি এক দফার আন্দোলনের নতুন কোনো কর্মসূচি দেয়নি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে আমরা আবার অল্প সময়ের মধ্যে মাঠে আসব। আমাদের দাবি একটাই, এই সরকারের পদত্যাগ।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন, গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক অবস্থান ও ঘেরাওয়ের মতো টানা কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। নেতা-কর্মীরাও সেভাবে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা পুরোপুরি রক্ষা করা যায়নি, কিছুটা ছেদ পড়েছে।
রাজপথে অবস্থান বা ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিতে সরকার কতটা কঠোর হতে পারে অথবা পরিস্থিতি কী হতে পারে—এ বিষয়ে সঠিক মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা বিএনপির ছিল না। সে কারণে ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি সফল হয়নি এবং এর প্রভাবে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে বলেও দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিকদের সঙ্গে কথা বলছি। চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যেতে একটু সময় লাগছে। এখন জনসম্পৃক্ততা বাড়ায় এমন কর্মসূচি দেব।’
বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের আরেকজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীনদের অবস্থানসহ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই এগোতে চাইছেন তাঁরা। কর্মসূচির ধরন কী হতে পারে, সে ব্যাপারে শরিকদের মতামতও নেওয়া হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বৈঠক করে অল্প সময়ের মধ্যেই এক দফা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আগে টানা কয়েক দিনের কর্মসূচির মাধ্যমে অল্প সময়েই চূড়ান্ত আন্দোলন পরিণতিতে যাওয়ার কৌশল ভেবেছিল। কিন্তু বাস্তবতা যে কঠিন, সেটা এখন বিবেচনায় নিচ্ছেন তাঁরা। ফলে আগের কৌশলে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। চূড়ান্ত পর্যায়ের জন্য আরও প্রস্তুতি প্রয়োজন বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করছেন।
বিএনপি এখন এক দফার আন্দোলনের নতুন যে কর্মসূচি নিতে যাচ্ছে, তাতে গণমিছিল, মিছিল, সমাবেশের মতো কর্মসূচি থাকতে পারে। এসব কর্মসূচি ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়ে মহানগর, জেলা-উপজেলা পর্যায়েও দেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে অবস্থান-ঘেরাওয়ের মতো টানা কর্মসূচিতে যেতে দলটির নেতারা কিছুটা সময় নিতে চাইছেন। এই সময়ে গণমিছিল, সমাবেশের মতো কর্মসূচি দিয়ে একদিকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, অন্যদিকে নেতা-কর্মীদের আবার উজ্জীবিত করার কৌশল নিয়েছে দলটি। এ ছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মূল্যায়ন হচ্ছে, সর্বশেষ অবস্থান কর্মসূচিতে ছাত্র, তরুণ, যুবক এবং পেশাজীবীদের সেভাবে নামানো সম্ভব হয়নি। সে জন্য চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে কিছুটা সময় নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র ও যুবসংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি।
আন্দোলনকারী দলগুলোর সমর্থক আইনজীবীরা ইতিমধ্যে একটি জোটে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে এখনো সেটি হয়নি। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সমর্থক ছাত্রসংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোও একইভাবে ঐক্যবদ্ধ জোট করতে চাইছে।
সরকার এ মুহূর্তে বিএনপিকে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছে। এর উদাহরণ হিসেবে বিএনপির নেতারা বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ সালে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাটি হয়েছিল। এক দফার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এই রায় এল। সরকারের কৌশলের অংশ হিসেবে দ্রুততার সঙ্গে মামলাটির বিচার শেষ করা হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে এখন এক দফার বাইরেও বিএনপির জন্য এটি বড় ইস্যু।
এ ছাড়া সারা দেশেই বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে পুরোনো বিভিন্ন মামলায় বিচার দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দলটির নেতারা অভিযোগ করে আসছেন। তাঁরা বলছেন, পুলিশের ধরপাকড় ও পুরোনো মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার বেড়েছে। ফলে এসব ইস্যুতে বিএনপিকে ব্যস্ত করা হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, বিএনপিকে বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যস্ত রাখা কৌশলের অংশ। বিরোধী দলের কর্মসূচি মোকাবিলায় সামনে আরও কঠোর হবে সরকার। এ বিষয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রবল আন্দোলনের মুখেও বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন করেছিল। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান এনে সংবিধান সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি। এখন বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে হয়তো সেই প্রতিশোধ নিতে চাইছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে দেবে না।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, রাজপথে বিএনপি শক্তি দেখানোর চেষ্টা করলে তাদের কঠোরভাবে জবাব দেওয়া হবে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যেমন মাঠে থাকবেন, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কঠোর ভূমিকায় থাকবে।
ক্ষমতাসীনদের কঠোর অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় ‘সতর্ক পাহারার’ নামে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। তাঁরা ছিলেন মারমুখী। পুলিশও ছিল কঠোর ভূমিকায়।
এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষ থেকেই কোনো আলোচনা বা সমাধানের কোনো উদ্যোগ কার্যত দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একে অপরকে রাজপথেই হারাতে চাইছে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ক্ষমতাসীনেরা আক্রমণাত্মক অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। বিএনপিও ছাড় দেওয়ার মানসিকতায় নেই। ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা বাড়ছে।
এসএইচ-০১/০৪/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : প্রথম আলো)