গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে এই খাতে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য সার সরবরাহকারীদের পাওনার পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। পাশাপাশি সার আমদানি করতে যে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দরকার, তারও সংকট চলছে।
অপরদিকে, জ্বালানি আমদানিতেও প্রয়োজনীয় মার্কিন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি খাতও পণ্য আমদানি করতে গিয়ে সংকটে পড়ছে। আবার রাজস্ব আদায় যথেষ্ট পরিমাণে না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ-সারসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির টাকাও যথাসময়ে দিতে পারছে না।
জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন এক পরিস্থিতিতে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জন্য দেড় কোটি টাকার গাড়ি কেনার যে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অথচ এক মাস আগেই গত ২ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে ও কৃচ্ছ্রসাধনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি দপ্তরে সব ধরনের যানবাহন ক্রয় বন্ধ থাকবে জানিয়ে পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে, গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য সর্বোচ্চ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে (ট্যাক্স, ভ্যাটসহ) সর্বোচ্চ ২ হাজার ৭০০ সিসির গাড়ি কেনা যাবে।
গ্রেড-৩ ও এর নিচের গ্রেডের কর্মকর্তাদের জন্য রেজিস্ট্রেশন, ট্যাক্স ও ভ্যাট খরচসহ সর্বোচ্চ ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অনূর্ধ্ব ২ হাজার সিসির গাড়ি কেনা যাবে।
এর আগে, গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ির সর্বোচ্চ দাম ছিল ৯৪ লাখ টাকা এবং গ্রেড-৩ থেকে নিচের দিকের কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫৭ লাখ টাকা।
টাকা ও ডলার ঘাটতির কারণে সার ও জ্বালানি সংকট, ব্যাংক খাতের সম্পদ হ্রাস, পুঁজির দেশান্তর, নিত্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির মতো সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সমস্যার মধ্যেই সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি কেনার পথ খুলে দেওয়ার পাশাপাশি গাড়ির বাজেট বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের সঙ্গে।
তাদের ভাষ্য, হঠাৎ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার এমন কোনো উন্নতি ঘটেনি যাতে কর্মকর্তাদের ‘গাড়িবিলাসের’ জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। বিদ্যমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে কৃচ্ছ্রসাধনের আগের যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তটি সাংঘর্ষিক ও অসঙ্গতিপূর্ণ।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের পর্যবেক্ষণ হলো, নির্বাচনের আগে কোনো একটি বিশেষ মহলকে খুশি করতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি দপ্তরে সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, কোনো সময় এক্সট্রিম সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। অনেক সময় গাড়ি কেনার জরুরি দরকার হতে পারে। গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে রিপ্লেস করার দরকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে সীমিত করার প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সেটা অন্তত ১ বছর দেখা দরকার ছিল।’
তা না করে চটজলদি আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পাশাপাশি গাড়ি কেনার বাজেট বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই চট করে এভাবে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি একটা সংশয় তৈরি করেছে। আমার মনে হয় সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে এবং কোনো বিশেষ একটা মহলকে খুশি করার জন্য এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’
আলী ইমাম মজুমদারের ধারণা, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত জনমানসেও একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের আশপাশের দেশ ভারত, নেপাল- এদের অবস্থা যদি দেখি, এদের সরকারি অফিসাররা আমাদের মতো এক্সপেনসিভ গাড়ি ব্যবহার করে না। তারা তাদের দেশে নির্মিত মাঝারি মানের গাড়ি ব্যবহার করে। নেতাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় এরা আরও সস্তা গাড়ি ব্যবহার করে।’
‘আমাদের একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর যে গাড়িগুলো কেনা হবে তা অবশ্যই ইমপোর্টেড গাড়ি হবে। এগুলো তো আর দেশে (তৈরি) হচ্ছে না। তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে গাড়িগুলো কিনতে হবে। এই অপচয়টা একদিক থেকে না, সংকটটাও একদিক থেকে না’, বলেন তিনি।
বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ অভিহিত করে এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘জাতির সামগ্রিক সংকটের মধ্যেও সরকার এটিকে তোয়াক্কা করছে না। আরও অনেকগুলো জিনিস আছে। ব্যয় সাশ্রয়ী পলিসি হিসেবে উচিত ছিল, আমরা এখন প্রত্যেক বছর যে রেভিনিউ খরচ করছি সেগুলো অ্যাসেসমেন্ট করে দেখা যে কোনগুলো অ্যাভয়ডেবল। সে খরচগুলো না করা। বাজেটের মধ্যে সেগুলো সংকোচন করা। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ খরচ কমিয়ে আনা। কিন্তু আমরা সেদিকে একেবারেই যাচ্ছি না।’
অপচয়ের উদাহরণ হিসেবে রাজশাহীর একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি গাড়িতে এসি ফিট করা হচ্ছে। রাজশাহীর একটি মিটিংয়ে দেখা গিয়েছিল সরকারি কর্মকর্তারা মিটিংয়ে ঢুকেছেন আর ড্রাইভাররা সবাই এসি চালিয়ে ঘুমাচ্ছে। এগুলো কোনোভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে না।’
‘ব্যয় সংকোচন নীতিটাকে মনিটরিং করা হচ্ছে না। নতুন নতুন করে খরচ বাড়াচ্ছে (সরকার)। কোনোভাবে ব্যয় সাশ্রয় করা হচ্ছে না। বরং অপচয়টা চূড়ান্ত সীমায় চলে গেছে। দরকারে অবশ্যই খরচ করবে। কিন্তু অপচয় কেন করবে’, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্য, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য যানবাহন ক্রয় বা বরাদ্দের ক্ষেত্রে নতুন দাম নির্ধারণ করার পেছনে বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল, এরকম ভাবাই স্বাভাবিক। এর আগে, সর্বশেষ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এ মূল্য নির্ধারণের প্রায় ৪ বছর পর এই পুননির্ধারণও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের আলোকে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা গভীরতর যাচাই করার সুযোগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে ও সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি দপ্তরে সব ধরনের যানবাহন ক্রয় স্থগিত রাখার যে পরিপত্র অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২ জুলাই জারি করেছিল, সেখান থেকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সরে এসে এই উল্লম্ফন যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবর্তিত পরিস্থিতি কতটুকু তৈরি হয়েছে? দ্বিতীয়ত, এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আর্থিক সক্ষমতার মাপকাঠির তুলনায় অন্য কোনো বিষয়কে কি অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া হলো?’
ইফতেখারুজ্জামানের ভাষ্য, ‘সরকারি খাতের অন্য সব ব্যয়ের মতো সরকারি কর্মচারীদের যানবাহন ক্রয় ও ব্যবহার বাবদ খরচের বোঝা যেহেতু জনগণকে বইতে হয়, সেজন্য এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া অপরিহার্য।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম’র নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, সরকারি পর্যায়ে কৃচ্ছ্রসাধনের আগের যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তটি সাংঘর্ষিক ও অসঙ্গতিপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘কী কারণে এই সিদ্ধান্ত বদল হলো সেটা ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সেরকম কোনো উন্নতি ঘটেনি। সরকারি আয়ের যে স্থিতি সেখানেও এমন কোনো ইমপ্রুভমেন্ট ঘটেনি। সেখানে এই কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যাপারটা অন্তত এ বছরের শেষ পর্যন্ত অথবা সামনের বছরের ফার্স্ট কোয়ার্টার পর্যন্ত কন্টিনিউ করা উচিত ছিল।’
সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমরা এটাও জানি যে, সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু অনিশ্চয়তা আছে। এসময়ে খরচের জায়গায় অনেক রাশ টেনে ধরার দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রে খরচের যে জায়গাগুলো শিথিল করা হয়েছে, সেই সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ আছে বলে মনে করি।’
তার অভিমত, ‘এমন একটি (সংকটকালীন) সময়ে মানুষ দেখতে চায় সরকার যখন সবাইকে কৃচ্ছসাধনের কথা বলছে, তখন সে নিজেও এটা করছে। নিজে করে একটা উদাহরণ তৈরি করছে। অর্থনীতির অবস্থা আরেকটু ইম্প্রুভ হলে এগুলো বিবেচনা করার সুযোগ ছিল। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বিভিন্ন রকম অ্যাডজাস্টমেন্টের সুযোগ থাকে। সেই অ্যাডজাস্টমেন্টের দিকে না গিয়ে বরং আরও খরচ করার যে সিদ্ধান্ত তা আগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ না।’
এসএইচ-০৩/০৫/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার)