গত মাসে সরকার যখন দেশের ইতিহাসে প্রথমবার ডিম-আলু-পেঁয়াজের মতো কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারিত করে, তখন সেটি যেমন অনেককে আশান্বিত করেছিল, তেমনি এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশের লোকেরও অভাব ছিল না। আর এরপর মাস পার না হতেই সংশয় যেন সত্যি মনে হচ্ছে।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি পিস ডিমের দাম কোনভাবেই ১২ টাকার বেশি হবে না। অথচ ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের এখন ডিম কিনতেই খরচ পড়ছে ১২ টাকার উপর। বৃহস্পতিবার বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি ডজন ডিম কিনতে ক্রেতাদের খরচ হচ্ছে ১৬০ টাকার মতো।
আলুর বাজারেও একই অবস্থা। সরকারের ৩৫টাকা কেজি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া আলুর সর্বনিম্ন মূল্য এখন ৫০ টাকা।
আলুর যখন হাফসেঞ্চুরি তখন সেঞ্চুরির পথে পেঁয়াজ। সরকারের ঠিক করে দেয় দেশি পেঁয়াজের বিক্রয়মূল্য হবে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা, কিন্তু এখন তা ৯০ টাকা ছাড়িয়েছে।
ক্রেতা, বিক্রেতা এবং বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের দাম নির্ধারণ করে ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার’ চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সরকারের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও মনে করে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন আছে।
“সরকার যে রেট দেয় এটার কোন মূল্য নাই, কারণ এটা কখনোই মিলে না, তারা এটা কার্যকর করতে পারে না। তাই শুধু শুধু এই রেট দিয়ে মানুষের কাছে সরকারের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয়,” বলছিলেন বাড্ডায় এক জেনারেল স্টোরের মালিক আলমগীর হোসেন।
তার দোকানেই বাজার করছিলেন হাসিনা আরা রসুল। তিনি বলেন, সরকারের দাম বেঁধে দেবার উপর আর কোন বিশ্বাস নাই।
“সরকার বলে দাম কমবে, কিন্তু তার কোন ভাব নেই, বরং বেড়ে যাচ্ছে। আগে যা যা কিনতাম তার থেকে অনেক কম কিনতে হয় এখন।”
বাজারে বেশিরভাগ ক্রেতা-বিক্রেতার কন্ঠে একই সুর। আর বর্তমান পরিস্থিতি এই দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কটাকেও করে তুলেছে তিক্ত।
“সব জিনিসের দাম বাড়তি, ফলে মানুষের সাথে ঝগড়া হয়, কাস্টমার ফেরত চলে যায়, কিন্তু কিছু করার নাই, ব্যবসা করে যেন আরও বিপদে পড়ছি,” বাড্ডা এলাকার আরেক দোকানদার মেহেদী হাসান বলেন।
তিনি বলেন পেঁয়াজের দাম গত এক মাসে কয়েক ধাপে বেড়েছে। ৫ টাকা, ৭ টাকা, ২ টাকা করে বাড়তে বাড়তে সেটি ৭৫ থেকে ৮০ হয়ে এখন ৯২ টাকায় চলে গেছে।
ডিমের অবস্থাও তাই। গত প্রায় মাসখানেক ধরেই একবার ৫ টাকা কমে তো পরক্ষণেই আবার ১০ টাকা বাড়ে বলেন জানান আরেক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী।
বাজারে এই মূহুর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে কেবল তেলের দামেই যা একটু নাগাল দেখা গেল। প্রতি লিটার ১৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন। চিনির দামও কেজিতে ৩ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৩২ টাকায়।
এছাড়া প্রায় সব পণ্যেরই দাম বাড়তি দেখা যায়। গৃহিণী আনজুম আরা বেগম বাজার করতে এসে অভিযোগ করলেন, “একেকদিন একেকটা দাম, কোনদিন ৫ টাকা কমে তো কোনদিন আবার ৫ টাকা বাড়ে। বড়লোকরা তো খাইতে পারতেছে, কিন্তু যারা দিন আনে দিন খায় তারা পারতেছে না।”
গত ১৪ই সেপ্টেম্বর ডিম, আলু ও পেঁয়াজ এই তিন পণ্যের নির্ধারিত দাম ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে এ দাম নির্ধারণ করা হয়। এই দামের বিষয়টি বাজারে তদারকি ও বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেয়া হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে।
এর মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “আমরা কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছি, নিয়মিত অভিযান, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি কার্যক্রমের পাশাপাশি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়ার পর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার বেড়ে গিয়েছে।”
তবে এই দাম বেঁধে দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে তার। তিনি মনে করেন, এককভাবে কাজ করলে এতে ফল পাওয়া যাবে না।
“ডিম যে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ১০ টাকা ঠিক করে দিল, আর খুচরা পর্যায়ে ১২ টাকা, কিন্তু পরে তো উৎপাদন পর্যায়েই সাড়ে ১১টা বিক্রি হচ্ছে, সেটা তো তাদের দেখভাল করার কথা।”
সফিকুজ্জামান বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে আলু-পেঁয়াজের যথেষ্ট উৎপাদন হয়েছে, কিন্তু তাহলে এত ঘাটতি হল কেন?
তিনি মনে করেন, উৎপাদন বেশি হলে দাম এত বাড়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে দেরি হওয়া দাম বৃদ্ধির একটা কারণ।
“কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো, আবার ভারত থেকেও যথেষ্ট পেঁয়াজ আসছে, কিন্তু বাজার তো নিয়ন্ত্রণে নেই।” এক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব আছে বলে মনে করেন তিনি।
একইসাথে নিজেদের লোকবল সংকট ও আইনি বাধ্যবাধকতার কথাও উঠে আসে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কথায়।
“আমাদের ১৭টি জেলায় কোন অফিসার নেই। সেখানে আমরা প্রতিটি জেলায় কাজ করার চেষ্টা করছি স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে।”
“এখন দেশি পেঁয়াজ কৃষকরা বাজারে এনে বিক্রি করছে ৭০/৮০ টাকা দরে, সেটা তো ঢাকায় এসে সেঞ্চুরি করবেই। আমরা তো আর কৃষককে ৫৫/৬০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারি না।”
সফিকুজ্জামান বলেন, “আমি নিজে হিমাগারে গিয়ে ধরলাম যে আলু রেখে দিয়েছে, তাকে পুলিশে সোপর্দ করলাম, কিন্তু এরপর যদি এদের বিরুদ্ধে মামলা করা না যায় তাহলে তো এই সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না।”
আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার মনে করে বিপণণ ব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো উচিত। উৎপাদন থেকে খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি হাতবদলে দামের যে বড় পরিবর্তন ঘটানো হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রকৃত ডকুমেন্ট রাখার কথা বলেন তিনি।
“সামনে ডিমান্ড এবং সাপ্লাই নিশ্চিত করতে না পারলে বাজার যে কোন দিকে যেতে পারে। কোন পণ্যের ক্রাইসিস হলেই ব্যবসায়ীদের সেটার সুযোগ নেয়ার মানসিকতা বদলাতে হবে।”
সফিকুজ্জামান বলেন ব্যবসায়ীদের অতিরিক্তি মুনাফার চিন্তা না করে নিজেদের দায়িত্ব বোধ থেকে এগিয়ে আসা উচিত।
ডিম-আলু-পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করেও তা কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কেউই বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলতে রাজি হননি।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ।
অর্থনীতিবিদ আসাদুজ্জামান মনে করেন, চাহিদা ও জোগানের উপর নির্ভরশীল জিনিসের দাম বেঁধে দিলে তা খুব বেশি কাজে আসে না।
“যেমন আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখা যায় কিন্তু কাঁচা মরিচ তো রাখা যায় না, তাহলে এটার কেন এত দাম বাড়লো। তাহলে সমস্যাটা প্রডাকশনে, কিন্তু সেটা কেউ বলে না।”
অর্থনীতিবিদ আসাদুজ্জামান বলেন, উৎপাদন যে কোনটার আসলে কত, সেটার কোন সঠিক হিসাব নেই, একটার সাথে আরেকটা মিলে না। এ কারণেই দাম বেঁধে দিলে তা কোন কাজে আসছে না, কারণ সমস্যাগুলো থেকেই যাচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার আরেকটা কারণ হিসেবে এই অর্থনীতিবিদ তুলে আনেন মূল্যস্ফীতির সময় নতুন টাকা সরবরাহের বিষয়টি।
“এটা হয়েছে আগুনে ঘি ঢালার মতো। যখন সবকিছুর দাম বাড়তি, সরকারও স্বীকার করছে, সেসময় মানি সাপ্লাই ছিল সুইসাইডাল,” বলেন আসাদুজ্জামান।
এসএইচ-০১/১৩/২৩ (ফয়সাল তিতুমীর,বিবিসি)