চীনা প্রভাব আটকাতে আমেরিকাকে ‘টাকা-পয়সা’ নিয়ে আসতে হবে!

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি দাবি করেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানকে বলেছেন, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব আটকাতে হলে আমেরিকাকে ‘টাকা-পয়সা’ নিয়ে আসতে হবে।

বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ওয়াশিংটনে জ্যাক সুলিভানের সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি তাকে বলেছেন “আপনারা খালি উপদেশ, আর হুকুম, আর ভয়… ও দিয়ে কিন্তু চায়নারে কনটেইন করা যাবে না। করতে হলে টাকা-পয়সা নিয়ে আসেন। উনি আমাকে বললেন যে, উনি চেষ্টা করতেছেন, হি আন্ডারস্টুড ইট।”

মোমেন জানান, মি. সুলিভান বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। একই সাথে তিনি(মি. সুলিভান) জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ২০০ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল তৈরি করতে চায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেয়ার জন্য।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, বাংলাদেশে কার প্রভাব বেশি থাকবে সে ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ কী না?

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় প্রয়োজন হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ। তবে পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের অবকাঠামোগত খাতে দীর্ঘ সময় ধরেই কোন ধরণের বিনিয়োগ করে না।

ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের যদি চীনের বিকল্প হিসেবে আসতে হয় বা বাংলাদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়, তাহলে অবশ্যই বিনিয়োগ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৩ সালের বিনিয়োগ পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৩.৪৪ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে জ্বালানি খাতে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় “বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা সহযোগিতা জোরদারকরণ” সমঝোতা স্মারক সই হয়। এই স্মারকের আওতায় ২০ বিলিয়ন ডলার খরচে ২৭টি প্রকল্পে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এরমধ্যে অন্তত ২৫টি প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে চীন।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে চীন এখন পর্যন্ত ৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বড় বড় প্রকল্প চীনের অর্থায়নে গৃহীত হয়েছে। এছাড়া বড় প্রকল্পগুলোতে চীন ঠিকাদার হিসেবেও কাজ করছে।

চীনের বিস্তৃত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সফট পাওয়ার বাড়ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে অবকাঠামো খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে।

সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর মনে করেন, এই বিষয়টি এরই মধ্যে পশ্চিমাদের নজরে এসেছে এবং তার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেও শুরু করেছে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, সম্প্রতি জাপানের হিরোশিমা শহরে জি-৭ ভূক্ত দেশগুলোর যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে এই অঞ্চলে ৬০০ বিলিয়ন ডলার অবকাঠামোগত বিনিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।

এছাড়া দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনেও এই অঞ্চলে বিনিয়োগের বিষয়টি স্থান পেয়েছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলো বর্তমানে আগ্রহী হচ্ছে বলেও জানান মি. কবীর।

সহজ ও আকর্ষণীয় শর্ত ও উপাদান নিয়ে কেউ বিনিয়োগ করতে আসলে বাংলাদেশের সেটা লুফে নেওয়াটাই স্বাভাবিক।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. সাহাব এনাম খান বলেন, বাংলাদেশ এখন চীনের বলয়ে আছে বলাটা ঠিক হবে না। বরং বাংলাদেশ একটা বৈচিত্র্যময় পররাষ্ট্র পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। তবে এট সম্পন্ন হতে সময় লাগবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে চীন এরই মধ্যে বলে দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নয়।

তবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটা তাগিদ রয়েছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার মতো ইস্যুগুলো নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। যাকে বাংলাদেশ সরকার নিজেদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ বলেই মনে করে।

বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে গত ১৫ বছরে চীন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। রাস্তা, সেতু, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে এবং নানা অবকাঠামো তৈরি করা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এসব খাতে উন্নয়নের জন্য বড় ধরণের বিনিয়োগ কিংবা ঋণ দরকার।

সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত খাতে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু চীনের মতো বিনিয়োগ করে না, চীনের বিকল্প হিসেবে আসতে হলে বা বাংলাদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলে অবশ্যই এ খাতে নজর দিতে হবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিষয়টি যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মূল্যবোধের দিক থেকে সম্পর্ক আছে। গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত। এছাড়া জাতিসংঘের আওতায় বাংলাদেশ যে শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করে সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্টতা বজায় রেখে কাজ করতে হয়।

“কাজেই বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু অর্থনৈতিক বিবেচনার মধ্যে আনাটা বোধহয় ঠিক হবে না। এটা আরো বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আমরা এটা নিয়ে কাজ করি। অর্থনীতি হয়তো একটা উপাদান।”

আবার অনেকেই বলছেন, দুই দেশের বিনিয়োগের প্রকৃতি এক নয়। যার কারণে এ খাতে দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতার প্রশ্নটা আসে না।

এ বিষয়ে সাবেক কূটনীতিক তৌহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ আর চীনের বিনিয়োগ এক জিনিস নয়। চীনারা বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পের সাথে যুক্ত রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রকল্পে তারা ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে।

চীনের যে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার অঙ্গীকার করেছিল, সেখান থেকে এখনো পর্যন্ত ৭-৮ বিলিয়নের বেশি অর্থ ছাড় হয়নি।

তিনি বলেন, “চীন প্রজেক্টগুলিতে অর্থ লগ্নি করছে, লোন দিচ্ছে… এবং সেই প্রজেক্টগুলির প্রায় সবগুলিই ওভারপ্রাইজড(অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারিত), যেখানে প্রচুর দুর্নীতির সুযোগ আছে।”

হোসেন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চীনের মতো এ ধরণের কোন প্রকল্প হাতে নেয়া বা এ ধরণের অর্থ লগ্নি কারাটা সম্ভব নয়। কারণ তাদের দেশের আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র এ ধরণের কোন প্রকল্প হাতে নিতে পারবে না।

তাই বিনিয়োগ দিয়ে চীনের প্রভাব কমিয়ে দিতে হবে- এটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয় বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. সাহাব এনাম খান বলেন, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র দুটি দেশই বাংলাদেশের বড় দুই বিনিয়োগকারী দেশ। বাংলাদেশ সব সময়ই এদের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। কারণ দুই দেশই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেকোন একটি দেশকে বাদ দিয়ে আরেকটি নিয়ে ভাবার সুযোগ এখানে নেই।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসআইডির মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবাধিকারসহ বিভিন্ন প্রকল্পে সহায়তা দেয়া হয়।

কিন্তু সেটির অংক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মতো অতোটা বড় নয়।

সাহাব এনাম খান বলেন, আমেরিকান বিনিয়োগ বা অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেশটির পররাষ্ট্র নীতির সাপেক্ষে হয়ে থাকে। আর এই নীতি মূলত দুটি বিষয়- প্রকল্পের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার উপর নির্ভরশীল।

এ কারণে বাংলাদেশ যদি সামনে বছর গুলোতে আরো বেশি পরিমাণ মার্কিন বিনিয়োগ চায় তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরো বেশি জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তার মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজে থেকেই উদ্যোগি হতে হবে।

“আর আমেরিকা তখনই প্রো-অ্যাকটিভ হতে পারবে যখন তার স্ট্যান্ডার্ডে অ্যাকাউন্টিবিলিটি ও ট্রান্সপারেন্সি মেজারগুলি নেয়া হবে।”

“পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি বলেও থাকেন যে আমেরিকাকে টাকা দিতে হবে তাহলে টাকাটা দিবে কিভাবে? তার তো আইনি জটিলতা আছে।”

খান বলেন, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র দুটি দেশই বাংলাদেশের বড় দুই বিনিয়োগকারী দেশ। বাংলাদেশ সব সময়ই এদের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। কারণ দুই দেশই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেকোন একটি দেশকে বাদ দিয়ে আরেকটি নিয়ে ভাবার সুযোগ এখানে নেই।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানী বা ইউএসএইআইডি’র মতো নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে থাকে।

তিনি বলেন, আমেরিকান বিনিয়োগ বা অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেশটির পররাষ্ট্র নীতির সাপেক্ষে হয়ে থাকে। আর এই নীতি মূলত দুটি বিষয় প্রকল্পের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার উপর নির্ভরশীল।

এ কারণে বাংলাদেশ যদি সামনে বছর গুলোতে আরো বেশি পরিমাণ মার্কিন বিনিয়োগ চায় তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরো বেশি জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তার মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজে থেকেই উদ্যোগি হতে হবে। “আর আমেরিকা তখনই প্রো-অ্যাকটিভ হতে পারবে যখন তার স্ট্যান্ডার্ডে অ্যাকাউন্টিবিলিটি ও ট্রান্সপারেন্সি মেজারগুলি নেয়া হবে।”

“পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি বলেও থাকেন যে আমেরিকাকে টাকা দিতে হবে তাহলে টাকাটা দিবে কিভাবে? তার তো আইনি জটিলতা আছে।”

এসএইচ-০৬/১৪/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : বিবিসি)