শর্তের বেড়াজালে বন্দি সংলাপ!

মার্কিন প্রাক্‌–নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অংশীজনদের মধ্যে অর্থবহ সংলাপের সুপারিশ করেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির শর্তের বেড়াজালে এই মুহূর্তে সংলাপের সম্ভাবনা নেই। দল দুটির নেতারা প্রকাশ্যে এমন ধারণা দিচ্ছেন। দুই পক্ষই পরিস্থিতির জন্য একে অপরকে দায়ী করছে।

বিএনপি চাইছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ। আর এই প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতে বা আপস করতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। এখন নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে কার্যত রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের দিকেই এগোচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, দুটি পক্ষই এই মুহূর্তে নিজ নিজ অবস্থানের সমর্থনে শক্তি দেখিয়ে জিততে চাইছে। ফলে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।

অন্যদিকে যদিও দুই দলেরই নেতাদের অনেকে সংঘাত এড়াতে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, কিন্তু তাঁরাও নিজেদের দলীয় অবস্থানের পক্ষে অনড় থেকে পরস্পরের ওপর চাপ সৃষ্টিতে দলের কৌশলকে সমর্থন করছেন।

মার্কিন প্রাক্‌–নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ঢাকা সফরের পর ফেরত গিয়ে গত শনিবার ওয়াশিংটন থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছে। তারা বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীল বক্তৃতা ও অর্থবহ সংলাপসহ পাঁচটি সুপারিশ করেছে। মার্কিন দলের এই বক্তব্য রোববার বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর অন্তত দুজন মন্ত্রী সংলাপ বা আলোচনার প্রশ্নে কথা বলেছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রোববার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ‘বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করছে তারা। আমরা সংলাপের চিন্তা করব তখন, যখন তারা (বিএনপি) এসব শর্ত প্রত্যাহার করে নেবে। শর্তযুক্ত কোনো সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই।’

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও রোববার সংবাদিকদের সঙ্গে মার্কিন দলের সংলাপের সুপারিশ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে সংবিধান বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না।

ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বিএনপির দাবিকে সংলাপের বাধা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, বিএনপিও একইভাবে দায় চাপাচ্ছে আওয়ামী লীগের ওপর। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের অধীনেই নির্বাচনের কথা বলছে এবং তারা সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার শর্ত দিচ্ছে। ফলে সংলাপের পথ আওয়ামী লীগই বন্ধ করে দিয়েছে।

একই সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা না দিলে এ সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপে আমরা যাব না। আমরা এখনো এই পুরোনো অবস্থানেই রয়েছি।’

যদিও বিদেশি কূটনীতিকদের দিক থেকে দুই দলের ওপরই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের ব্যাপারে চাপ রয়েছে। কয়েক দিন আগে একটি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন বলেও জানা গেছে। কিন্তু দুই দলই প্রকাশ্যে এই মুহূর্তে কোনো সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করছে।

আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের ব্যাপারে বিদেশি কূটনীতিকদের চাপ থাকলেও দুই পক্ষই একে অপরকে পরাজিত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে এবং সে কারণে তাদের কেউই নমনীয় হতে বা সংলাপের পথে হাঁটতে চাইছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও বিশ্লেষক সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে নমনীয় হলেই তার পরাজয় হবে—দুই পক্ষই এমনটা ভাবছে। ফলে এ পর্যায়ে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।

বিএনপির নেতারা মনে করছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মনোভাব থেকে সাধারণ মানুষের বড় অংশ বিরোধী দলের আন্দোলনকে সমর্থন করছে। এর সঙ্গে নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি এবং পশ্চিমা দেশগুলোর পদক্ষেপ বিএনপির জন্য সহায়ক হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে এবার ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো একতরফা নির্বাচন করা আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বিএনপির এবার আন্দোলন পরিণতির দিকে যেতে পারে।

এমন চিন্তা থেকে বিএনপি এখন ছাড় দেওয়ার অবস্থানে নেই। দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, যেহেতু নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সময় বেশি নেই, ফলে তারা সংলাপ বা আলোচনার প্রশ্নে কোনো চিন্তা করছেন না। তাঁরা রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়কেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে ফেললে ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি অস্তিত্বের সংকটে পরবে। এই পরিস্থিতির বিবেচনায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অবস্থানে অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে জন্য অক্টোবরের শেষেই ঢাকামুখী লংমার্চ বা অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা চলছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এক দফার আন্দোলনে যাওয়ার আগেই সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো সংলাপে না বসার কথা বলেছিল।

এখন সংলাপের আর কোনো সুযোগ নেই।’ এরপরও মার্কিন প্রাক্‌–নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলো তারা দলের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করবেন বলে মির্জা ফখরুল জানান।

বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ আবার মনে করেন, সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করে সংঘাত এড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু কখনো সংলাপ হলেও তা অর্থবহ হবে না বলে তাঁদের ধারণা।

সংলাপের প্রস্তুতি নেই আওয়ামী লীগের
বিএনপিসহ বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে প্রকাশ্য বা ভেতরে-ভেতরে আওয়ামী লীগের কোনো প্রস্তুতি নেই। ফলে শিগগিরই সংলাপের সম্ভাবনা দেখছেন না কেউ। আবার সংলাপের পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে—এমনটাও মনে করেন না আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নিরপেক্ষ সরকার, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ—এসব বিষয় অ্যাজেন্ডায় রেখে আওয়ামী লীগ কোনো সংলাপে যাবে না।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত। কিন্তু এক দফা দাবি তুলে বিএনপি সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এই দাবি নিয়ে তাঁরা কোনো আলোচনা করবেন না।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ বা সমঝোতার বিষয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো নমনীয় মনোভাব বা ইঙ্গিত দেননি। ফলে এটা বলা যায়, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হওয়ার এখনো কোনো বাস্তব লক্ষণ তৈরি হয়নি। আবার এটাও বলা যাবে না যে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হবেই না। সবকিছু নির্ভর করছে আওয়ামী লীগ সংলাপের জন্য কতটা তাগিদ অনুভব করছে বা বিদেশি চাপ আছে কি না—এসব বিষয়ের ওপর।

সংলাপের আহ্বান মার্কিন পর্যবেক্ষক দলের, সুযোগ দেখছেন না সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বড়জোর এক মাস বাকি আছে। এ পর্যায়ে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া, আয়োজন করা এবং এ থেকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো রাজনৈতিক বাস্তবতা দেশে নেই।

বরং সংলাপের চেষ্টা হলে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আওয়ামী লীগের যে দৃঢ় মনোভাব ও চেষ্টা, তা কিছুটা গতি হারাতে পারে। ফলে এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের আয়োজন করার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকে মনে করেন, দুই পক্ষই এখন চরম পর্যায়ের দিকে এগোচ্ছে এবং সংলাপের সুযোগ কমে যাচ্ছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সরকারের দায়িত্ব বেশি হলেও তাদের দিক থেকে একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতিই দৃশ্যমান হচ্ছে। এ কারণে সংঘাতের আশঙ্কাই বাড়ছে।

এসএইচ-০৬/১৬/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সুত্র : প্রথম আলো)