প্রায় আট বছর পর আবারো অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। রবিবার দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ টানা তিন দিনের এই অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
শনিবার বিএনপি’র সমাবেশে “হামলা, হত্যা, গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে” এবং সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ে ৩১ অক্টোবর, ১লা ও ২রা নভেম্বর তিন দিনের এই অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হলো।
বিএনপি বলছে, গত পাঁচ দিনে সারা দেশে বিএনপি’র দুই হাজার ছয়শত নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৪৫টি।
আর গেলো ২৮শে জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৪২টি। যেখানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে।
বিএনপি বলছে, তাদের ভাষায় এসব গ্রেপ্তার, নির্যাতনের অবসান এবং সরকার পতনের দাবি আদায়ের জন্যই তাদের অবরোধের নতুন কর্মসূচি।
অনলাইন প্রেস ব্রিফিংয়ে রিজভী জানান, অবরোধ পালিত হবে সারাদেশে সর্বাত্মকভাবে। এর আওতায় থাকবে রেলপথ, রাজপথ এবং নৌপথ।
কিন্তু এর আওতা কি হরতালের মতোই হবে নাকি শুধু জাতীয় মহাসড়ক এবং রেল ও নৌ-বন্দর কেন্দ্রিক হবে তা স্পষ্ট নয়। আহমেদের ব্রিফিংয়েও এ বিষয়ে আর কিছু বলা হয়নি।
তবে পরে রিজভী আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছেন, অবরোধ বলতে তারা সারা বাংলাদেশে সব ধরণের চলাচল বন্ধ করাকেই বুঝিয়েছেন।
তিনি বলেন, “অবরোধ কর্মসূচি মানে সর্বাত্মক অবরোধ। রাস্তা-ঘাট, রেল, নৌ সব বন্ধ থাকবে। এমনকি শহরের ভেতরেও সব ধরণের চলাচল বন্ধ থাকবে।”
বিএনপি’র কর্মসূচি পালনে বিভিন্ন সময়ই গুরুত্ব দেয়া হয় ঢাকার বাইরের জেলাগুলোকে ঢাকার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে রাখার উপর।
কিন্তু দলটির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে অবরোধ নিয়ে ঠিক কী বার্তা দেয়া হচ্ছে?
জানতে চাইলে দলটির গাজীপুর জেলা বিএনপি’র একজন নেতা কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল বলছেন, তাদের কাছে নতুন করে কোন বার্তা আসেনি কেন্দ্র থেকে।
তিনি বলেন, “কর্মসূচিতে তো পরিস্কার করেই বলা হয়েছে যে অবরোধ হবে রেলপথ, নৌপথ এবং রাজপথে। সুতরাং এখানে মূলত: যোগাযোগ ব্যবস্থাটাই থাকবে অবরোধের আওতায়। অফিস, আদালত, দোকানপাট এর আওতায় নেই।”
এদিকে বিএনপি’র এই অবরোধ কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়েছে সমমনা দলগুলোও।
আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই বিএনপি’র কর্মসূচি মোকাবেলায় রাজপথে শান্তি সমাবেশ করে আসছে। বিএনপি’র মহাসমাবেশ এবং হরতালের কর্মসূচিতে সহিংসতার ঘটনার পর আওয়ামী লীগ একে বর্ণনা করেছে, তাদের ভাষায় “রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার দু:সাহস হিসেবে।”
তবে রোববার সন্ধ্যায় যখন বিএনপি নতুন করে অবরোধের ডাক দিয়েছে, তখন আওয়ামী লীগ বলছে, অবরোধের কর্মসূচি ব্যর্থ হবে।
দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলছেন, বিএনপি হরতাল-অবরোধ যেটাই দিক, সেটা জনজীবনে কোন প্রভাব ফেলবে না। কারণ বিএনপি’র প্রতি জনসমর্থন নেই।
“অবরোধের তেমন কোন প্রভাব থাকবে না। হরতাল দিয়ে তারা আতংক সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সেটা কাজে আসে নাই। মানুষের শংকা কেটে গেছে। অবরোধ দিয়ে সাধারণ মানুষকে আর আতংকিত করা যাবে না”, বলছিলেন মি. হানিফ।
এর আগে বিএনপি’র প্রতিটি কর্মসূচিতে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকতে গেছে আওয়ামী লীগকে। শান্তি সমাবেশ ও উন্নয়ন শোভাযাত্রা নামে আওয়ামী লীগের এসব কর্মসূচি পালিত হয়েছে ঢাকাসহ সারা দেশে।
তবে মাহবুব উল আলম হানিফ এগুলোকে বিএনপি’র পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে মানতে নারাজ।
যদিও তিনি এটাও বলছেন, সামনের দিনগলোতেও আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে। তিনি বলছেন, “বিএনপি সুযোগ পেলেই আগুন সন্ত্রাস করে। এখানে আমরা শান্তি সমাবেশ করে থাকি। এতে করে বিএনপি মনস্তাত্বিক চাপে থাকে।”
“আমাদের উদ্দেশ্য কোন বিশৃংখলা যেন কেউ সৃষ্টি করতে না পরে। সামনের দিনগুলোতেও যেন মানুষের জীবন বিপর্যস্ত না হয়, সেজন্য একই ভাবে আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে।”
বিএনপি’র জন্য অবরোধ কর্মসূচি নতুন নয়। এর আগেও দলটি একটানা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। তবে সেটি এখন থেকে আট বছরেরও বেশি আগে।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর ২০১৫ সালে ওই নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ পালন করে দলটি৷
সে সময় মূলত অবরোধের ঘোষণা দেয়ার পর এক পর্যায়ে এর সঙ্গে হরতালকেও যুক্ত করে দলটি।
ওই হরতাল-অবরোধ এক পর্যায়ে সহিংস রূপ নেয়। একের পর এক বাসে আগুন ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের মতো ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
সরকার এসব ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটকে দায়ী করলেও তারা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে উল্টো সরকারকেই এর জন্য দায়ী করে আসছে।
তখন একটানা হরতাল অবরোধ চলতে থাকলে এক পর্যায়ে এটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। রাজপথেও অবরোধের সমর্থনে বিএনপি কিংবা বিশ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের আর দেখা যায়নি।
এক পর্যায়ে বিএনপি শেষ পর্যন্ত নিজেরাই সেই কর্মসূচি স্থগিত করে। ২০১৫ সালের এপ্রিলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া হরতাল-অবরোধ যুগপৎ কর্মসূচির অবসান ঘটান।
এর মাধ্যমেই বিএনপি’র অবরোধ কর্মসূচি শেষ হয়। এরপর দলটি আর অবরোধের কর্মসূচিতে যায়নি।
তবে এরপরও বিভিন্ন সময় বিএনপি হরতাল করেছে। সমাবেশ, লং মার্চও করেছে। যদিও দলটির পক্ষ থেকে বিভাগীয় সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি এবং লং মার্চের দিকে বেশি আগ্রহ দেখা যায় সাম্প্রতিক দিনগুলোতে। অবরোধ এমন কি হরতাল থেকেই সরে এসেছিলো দলটি।
রবিবার বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যে হরতাল পালন করেছে, সেটি ছিলো তিন বছর আট মাস পর হরতালের মতো কোন কর্মসূচি।
২০২০ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি যেটা দেয়া হয়েছিলো। তখন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ওই হরতাল ডেকেছিলো বিএনপি।
সেই হরতাল নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছিলো রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ দলটি সেবারও দীর্ঘ সময় পর হরতাল কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলো।
এসএইচ-০২/৩০/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : বিবিসি)