নভেম্বরের কয়েকটি দিন দেশের ইতিহাসে উত্তাল ও রক্তাক্ত

১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ- স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর দেশটিতে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হয় তারই একটি পরিণতি ছিল এই সাতটি দিনের রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহ।

১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের পর এর সাথে যুক্ত মেজরদের সাথে নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণ করেন। তবে খন্দকার মোশতাক সামনে থাকলেও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সেনা কর্মকর্তারা ছিলেন প্রবল ক্ষমতাশালী।

সেসময় বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজন মেজর বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর অনেককিছুই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।

এর তিন মাস পরেই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই যে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানটি হতে যাচ্ছিল তার প্রেক্ষাপটটি তৈরি হয়েছিল ক্ষমতার এই রক্তাক্ত পালাবদলের মধ্য দিয়ে।

অভ্যুত্থানের কারণ নিয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা থাকলে সেনাবাহিনীর তৎকালীন অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার একটি ফলশ্রুতি হচ্ছে নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান।

কারাগারে নিহত চার নেতা। ঘড়ির কাঁটার ক্রমানুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান

জুনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেকেই গ্রহণ করতে পারেননি’। এর বাইরে আরেকটি দ্বন্দ্বও ছিল, যার সূচনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনজন অফিসার ব্যাপক পরিচিতি পান । অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যুদ্ধের পর থেকে সেনাবাহিনীর মধ্যে এই তিনজন অফিসারের তিনটি প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছিল।

ব্রিগেডিয়ার হোসেন তখন ছিলেন ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডের মেজর পদমর্যাদার স্টাফ অফিসার।

যে তিনজন সেনা কর্মকর্তার কথা তিনি বলছেন তারা ছিলেন জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশারফ এবং কে এম শফিউল্লাহ।

“এই দ্বন্দ্বটা আগেও ছিল, কিন্তু সেটা প্রকট হলো ১৫ই অগাস্টের পরে। জেনারেল শফিউল্লাহ মোটামুটি বের হয়ে গেলেন, জেনারেল জিয়া ইন হলেন। আবার জেনারেল জিয়া ইন হওয়াতে তার এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের মধ্য দ্বন্দ্বটা আরো বাড়লো”।

১৯৭৫ সালে মেজর পদে ঢাকায় ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন।

১৫ ই অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের দিন দশেক পর সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে।

তিনি বলছিলেন, এরপর থেকে তিনি ‘সিনে ছিলেন না’ এবং অনেকটা গৃহবন্দী হিসেবেই সেনাপ্রধানের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।

নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহকে খালেদ মোশারফ এবং জিয়াউর রহমানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের একটি ফলাফল হিসেবে দেখছেন কে এম শফিউল্লাহ- “ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে করে খালেদ মোশারফ জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাকে সরিয়ে দিয়ে হাউজ এরেস্টও করে ফেলেছিল এবং নিজেই চিফ অফ স্টাফের র‍্যাংক পরলো।”

“ঐটা শেষ পর্যন্ত সে আর থাকতে পারে নাই এবং সেই ঘটনাটাই লিংগার করে ৭ তারিখে জিয়াউর রহমান তাহেরকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ মোশারফের ঐ গ্রুপটাকে সরিয়ে দেয়।”

তিনি বলছিলেন, সিনে না থাকলেও সেনাবাহিনীর মধ্যে যে একটি উত্তেজনা রয়েছে সেটি তিনি টের পাচ্ছিলেন এবং খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানটির পটভূমিও ছিল সেখান থেকেই।

নভেম্বরের ৩ তারিখের প্রথম কয়েকটি প্রহরে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়ার মতো দুটি ঘটনা ঘটে- একটি অভ্যুত্থান এবং ঢাকা কারাগারে একটি হত্যাকাণ্ড।

মধ্যরাত পার হবার পরই খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গভবন ঘেরাও করার জন্য যায় একটি ইনফ্রেন্টি ইউনিট, রেডিও স্টেশন দখল করে নেয় আরেকটি সেনাদল।

ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, বঙ্গভবন ঘিরে তখন এত বেশি সেনা সমাবেশ হয়েছিল যে ভেতরে থাকা মেজর ডালিম এবং মেজর নুরসহ সেনা কর্মকর্তারা আর পাল্টা কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আর এরই মধ্যে আকাশে যুদ্ধবিমানও উড়তে দেখা যায়।

“বঙ্গভবনের ওপর দিয়ে যখন দুটা কি তিনটা ফাইটার জেট উড়ে গেলো তখন তারা বুঝলো যে তাদের হাতে আর সময় নেই, তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হবে”।

সেদিন সকাল থেকেই একটি সমঝোতার চেষ্টা চলছিল। মেজর ডালিম এবং মেজর নুর বেশ কয়েকবার ক্যান্টনমেন্টে এসে খালেদ মোশারফের সাথে দেখা করেন। দিনভর নানা দেন-দরবারের পর সন্ধ্যায় ঠিক হলো তাদেরকে দেশ থেকে চলে যেতে দেয়া হবে।

সেদিনই রাতে একটি এয়ারক্রাফ্টে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাদের একটি বিমানে থাইল্যান্ডে চলে যেতে দেয়া হয়।

এদিকে সেই রাতেই কেন্দ্রীয় কারাগারে চলে একটি হত্যাকাণ্ড।

কয়েকজন সেনাসদস্যের হাতে খুন হন ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, তৎকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন জেলার আমিনুর রহমান বলেছিলেন, রাত একটা থেকে দেড়টার দিকে একটি পিকআপে করে কিছু সেনাসদস্য জেলগেটে উপস্থিত হন। এসময় আইজি প্রিজনের ফোন পেয়ে তিনিও সেখানে যান। এর কিছুক্ষণ পর তার কার্যালয়ের টেলিফোনটি বেজে ওঠে।

“টেলিফোন ধরলেই বললো যে প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সাথে। কথা শেষ করার পরই আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট ফোন করেছিলো। বললো যে আর্মি অফিসাররা যা চায় সেটা তোমরা করো”।

এরপর কারা মহাপরিদর্শক আমিনুর রহমানের হাতে চারজনের নাম লেখা একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলেন এদেরকে এক জায়গায় করো।

“সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন এক রুমে আর অন্য দুজন ছিলেন অন্য রুমে। তো অন্য রুম খুলে আনলাম”।

“আমি ভাবলাম কথাবার্তা বলবে তো পরিচয় করিয়ে দিই। মনসুর আলী সাহেব ছিলেন সর্বদক্ষিণে। তাকে পরিচয় করানোর জন্য মাত্র ম.. বলা শুরু করার সাথে সাথেই গুলি করে দিলো । গুলি করেই তারা খোলা গেট দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো”।

সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন ঐ জেলহত্যার ঘটনাটি তাৎক্ষনিকভাবে জানাজানি হয়নি। ঘটনাটি সেনা অফিসারদের কাছে পৌঁছে ৪ঠা নভেম্বর সকালের দিকে।

৩রা নভেম্বরের পরের কয়েকটি দিন কার্যকর দেখা যায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের গণবাহিনীকে। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন এই গণবাহিনী পরবর্তী অভ্যুত্থানে একটি মূল ভূমিকা পালন করে।

কর্নেল তাহেরের ভাই এবং গণবাহিনীর তৎকালীন ঢাকা মহানগর প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, জিয়াউর রহমানের থেকেই খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের খবরটি জানতে পারেন কর্নেল তাহের।

তিনি বলেন, ৩রা নভেম্বর ভোররাতের দিকে জিয়াউর রহমান ফোন করেন কর্নেল তাহেরকে।

“জিয়াউর রহমান বলেন, তাহের ওরা আমাকে বন্দী করেছে। আমার জীবন বিপন্ন”।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ছিলেন গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর প্রধান।

যদিও জিয়াউর রহমানের মূল টেলিফোন লাইনটি কেটে দেয়া হয়েছিল, তবে একটি প্যারালাল লাইন সচল থাকায় তিনি টেলিফোন কলটি করতে পেরেছিলেন বলে জানান অধ্যাপক হোসেন।

কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৭২ সালে। এরপর থেকে তিনি সরাসরি জাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন।এরই মধ্যে গঠিত হয় সেনাসদস্যদের নিয়ে সৈনিক সংস্থা এবং গণবাহিনী, যদিও বিষয়গুলো তখনো প্রকাশ্য ছিল না।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলছেন, নভেম্বরের ৩ তারিখেই কর্নেল তাহের নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন এবং এরপর থেকেই সৈনিক সংস্থার সদস্যরাসহ সেনাসদস্যরা তার সাথে দেখা করতে শুরু করেন।

খালেদ মোশারফ ক্ষমতা হাতে নিলেও দ্রুতগতিতে কোন সরকার গঠন করতে পারেননি। এর মধ্যেই অনেকটা অগোচরে ঘটে যায় জেল হত্যাকাণ্ড। এসব মিলিয়ে অনেকটা ‘সরকারহীন’ অবস্থার মধ্যে ছিল কয়েকটি দিন।

“এর মধ্যে জাসদ, গণবাহিনী এবং তাহের সৈনিকদের সাথে ক্রমাগত আলোচনা চালিয়ে যান” বলেন অধ্যাপক হোসেন।

নভেম্বরের ৫ এবং ৬ তারিখে গণবাহিনী আরো সক্রিয় এবং সংগঠিত হয়ে উঠতে শুরু করে। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা চলতে থাকে। সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, গণবাহিনী যে একটি কিছু করতে যাচ্ছে সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ৬ তারিখ বিকেলে, যখন ক্যান্টনম্যান্টের ভেতরে গণবাহিনীর নামে একটি লিফলেট ছড়ানো শুরু হয়।

ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, লিফলেটের একটি কপি তিনিও দেখেছিলেন।

লিফলেটে খালেদ মোশারফ, শাফায়াত জামিল এবং কর্নেল হুদাকে ‘ভারতীয় চর’ বলে প্রচার করা হয়।

এরই মধ্যে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট হিসেব শপথ পরানো হয়। কিন্তু প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীতে ঠিক কী হচ্ছে সেনিয়ে বেশ কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গিয়েছিলো।

“একটা ক্যু-তে যে হোমওয়ার্ক হয় সেটা ছিলো না। যে যার মতো করে চলছিল। এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে যখন ৬ তারিখ রাতে এই লিফলেট জওয়ানদের মধ্যে ছড়ানো হলো তখনি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে গণবাহিনী নামে একটি ফোর্স ক্যান্টনমেন্টের ভেতর কাজ করছে”।

এদিকে গণবাহিনীর বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনাটি হয় ৬ তারিখ সন্ধ্যায়।

“বিশাল একটি হলরুমের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রায় ৬০-৭০ জন সদস্য ছিলেন। সেখানে গণবাহিনীর নেতৃত্বস্থানীয়দের মধ্যে কর্নেল তাহের, তার পরের অবস্থানেই ছিল হাসানুল হক ইনু এবং আমি নিজেও ছিলাম। সেখানেই প্রত্যেকের কাজ ভাগ করে দেয়া হয়”- বলেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।

তবে তিনি বলেন, দলীয়ভাবে জাসদের সিদ্ধান্ত ছিল প্রস্তুতি নিয়ে ৯ই নভেম্বর অভ্যুত্থান হবে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় সেই রাতেই বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

৭ই নভেম্বর দিবাগত রাতেই শুরু হয়ে যায় পাল্টা অভ্যুত্থান। যার পুরোভাগে ছিল সেনাবাহিনীর জওয়ানরা।

কে এম শফিউল্লাহ বলছিলেন, সৈনিকদের মধ্যে স্লোগান উঠছিল ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, জেসিও ছাড়া র‍্যাংক নাই’।

“সিপাহীদের মধ্যে একটা হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল। তারা ভাবছিল অফিসাররা তাদের ব্যবহার করে উচ্চপদে উঠছে কিন্তু তাদের কথা কেউ চিন্তা করে না”।

সেই রাতেই মুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমানকে।

৭ তারিখ রাতে ক্যান্টনমেন্টে গোলাগুলির শব্দ শুরু হয়। কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা।

“জিয়াউর রহমানকে গণবাহিনী বের করতে পারেনি, তাকে রাতেরবেলা বের করলো ফোর বেঙ্গল আর টু ফিল্ড রেজিমেন্ট”।

সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, পরদিন সকালেই তিনি গণবাহিনীর সদস্য এবং কিছু সেনাসদস্যসহ সেনানিবাসে কর্নেল তাহেরকে দেখতে পান। এরপর জিয়াউর রহমানের সাথে কথা বলার সময় একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয়।

“তাহের চাচ্ছিলো জিয়াউর রহমান রেডিওতে গিয়ে গণবাহিনীর ১৩ দফা ঘোষণা করবেন এবং বলবেন যে তিনি এসব দাবী মেনে নিয়েছেন। এরপর সিপাহী-জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে সেই দাবী মেনে নেয়ার কথা জানাবেন”।

“কিন্তু তিনি যাননি। উনি তার আগেই তার ভাষণ রেকর্ড করে রেডিওতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখানেই তাহের এবং জিয়ার বিচ্ছেদ”।

ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সময় জওয়ানদের সাথে অনেককে অস্ত্রসহ বেসামরিক পোষাকেও অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল।

তবে ঐ অভ্যুত্থানে গণবাহিনী তাদের বেসামরিক সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বলছেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তিনি বলছেন, জাসদ যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল সেটি ব্যর্থ হবার এটিও একটি কারণ।

“কথা ছিল সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এলিফেন্ট রোডে নিয়ে আসবে। সেখানেই একটি বাসায় কর্নেল তাহেরসহ জাসদের নেতারা অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তারা সেটা করতে পারেনি”।

অধ্যাপক হোসেন বলছেন, গণবাহিনীর সাথে যুক্ত সৈনিকরাই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিল।

“জিয়াউর রহমান তাদেরকে বলেছিলেন যে কর্নেল তাহের তার বন্ধু এবং তাকেই যেন তারা এখানে নিয়ে আসে। এভাবে তারা কিছুটা প্রতারিতও হয়েছিল। তাদের ওপর যে সুনির্দিষ্ট যে নির্দেশ ছিল সেটা তারা করতে পারেনি”।

এদিকে ৭ই নভেম্বর সকালেই কর্নেল কে এন হুদার সাথে ঢাকায় রংপুর থেকে আসা ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হত্যা করা হয় খালেদ মোশাররফ, কর্নেল কে এন হুদা এবং ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারকে। খালেদ মোশারফকে কার নির্দেশে এবং কেন হত্যা করা হয়েছিল তার কোন সুনির্দিষ্ট তদন্ত হয়নি এবং সেই হত্যার কোন বিচারও এখনো পর্যন্ত হয়নি।

আনোয়ার হোসেন বলছেন, জিয়াউর রহমানের রেডিও ভাষণের পর অভ্যুত্থানে গণবাহিনীর ভূমিকা চাপা পড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা জন্মে যে, এটি পুরোপুরিই জিয়াউর রহমানের অভ্যুত্থান।

৭ই নভেম্বরের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান।

এর কিছুদিন পর ২৪শে নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে সামরিক আদালতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়।

দীর্ঘদিন পর ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে কর্নেল তাহেরের সেই বিচারকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৮১ সাল পর্যন্ত উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের মে মাসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে হত্যা করা হয়।

এসএইচ-০১/০৭/২৩ (অনলাইন ডেস্ক,বিবিসি)