দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি ও অন্য দলগুলোর আন্দোলনকে আমলে না নিয়ে নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
জানুয়ারির প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট করতে চায় ইসি। তবে তফসিল ঘোষণার পর বড় দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমাঝোতা হলে প্রয়োজনে তফসিল সংশোধন করতে পারবে নির্বাচন কমিশন। সেই সময় হাতে রেখেই ইসি তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে বলে রাজনীতিবিদ ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বৃহস্পতিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদকে অবহিত করেছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এরপর সিইসি সাংবাদিকদের জানান, দ্রুত তফসিল ঘোষণা করা হবে, ভোট হবে জানুয়ারির প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ৩০ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী ৩০ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে ভোট হতে হবে। ফলে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা আছে।
শুক্রবার মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সিইসি বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে পুরো দেশ মাতোয়ারা হয়ে আছে। পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিদিন বক্তব্য হচ্ছে। একটা ডাইমেনশনও পেয়ে গেছে। ভোট পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন দেশও আসছে। পুরো জাতি তাকিয়ে আছে।
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, ‘‘আমরা কমিশন থেকে দেখতে চাই- এমনভাবে দায়িত্ব পালন করবেন আপনাদের প্রজ্ঞা দিয়ে, যাতে সত্যিকার অর্থে নির্বাচনটা অবাধ-নিরপেক্ষ হয়। আমাদের মেসেজ হচ্ছে নির্বাচনটা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু, সুশৃংখল করতে হবে। সুশৃঙ্খল আমি করাতে পারবো না, আপনাদের করাতে হবে। ভোটের মূল কাজ ডিসি ও পুলিশ সুপারদেরকে করতে হবে। সমন্বয় করে নির্বাচনটা তুলে আনতে হবে।’
বৃহস্পতিবার রাতে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি করেছে শেখ হাসিনাকে। এই কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
শুক্রবার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এক সভায় ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হলে আমাদের হাতে সময় একেবারেই কম। নির্বাচনের আগে আমাদের দুইটা কাজ- একটা হলো নির্বাচনের প্রস্তুতি, আরেকটা হলো বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধীদলের আন্দোলনের নামে চোরাগোপ্তা হামলা মোকাবেলা করা এবং নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখা।’’
অন্যদিকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অজ্ঞাত স্থান থেকে বৃহস্পতিবার বিকালে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন৷ সেখানে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য গোটা জাতির নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে এবং আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু বঞ্চিত, ব্যথাহত, নিপীড়িত জনগণ সর্বশক্তি দিয়ে ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন হতে দেবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে সমমনা দল ও জোট এবং জামায়াত পৃথকভাবে একই কর্মসূচি দিচ্ছে।
জনদাবি উপেক্ষা করে ইসি তফসিল ঘোষণা করলে তা বয়কট করা হবে বলে জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারপরও তফসিল ঘোষণা করা হলে হরতাল দিয়ে মাঠে নামার হুমকি দিয়েছে তারা। শুক্রবার ঢাকায় গণমিছিল করে জোট নেতারা এই হুমকি দেন।
এখন পর্যন্ত নির্বাচনের কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে মনে করেন বাম জোটভুক্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সরকার আবারো একতরফা একটি নির্বাচনের প্রচেষ্টা করছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন সম্ভব না।’’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে বিএনপি নির্বাচনে গেলেও বাম জোট দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না দাবি করে প্রিন্স বলেন, “যদি আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, অথবা আওয়ামী-বিএনপি ৬০/৪০ ভাগাভাগি করে দলীয় সরকার করলো, তার অধীনে নির্বাচন হবে, সেটিও ভালো নির্বাচন হবে বলে আমরা মনে করি না।”
তবে প্রিন্স মনে করেন, তফসিল ঘোষণার পর রাজনীতির পরিবেশ বদলাতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন শুধু না, অন্যান্য অনেক মহল আছে, যারা সমঝোতা করে কিছু করার বিষয়ে সক্রিয়। ইসি যদি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়, আমার মনে হয়, নেপথ্যে এটাও থাকতে পারে, তাদের হাতে অনেক সময় থাকবে। কোনো কারণে তারা আলাপ-আলোচনার ধারা, অন্ততপক্ষে বাইরের মানুষকে দেখানোর জন্য, কারণ এখানে বিদেশি শক্তি, নানা ঘটনা আছে। তাদের দেখানোর জন্য সমঝোতার চেষ্টা করছি- এমন একটি প্রচেষ্টা নিতে পারে৷’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম মনে করেন, ২০১৪ সালের মতো সহিংসতার দিকে আগাচ্ছে দেশ। তিনি বলেন, নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের মধ্যে একটি হচ্ছে সব রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে যাদের গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে রয়েছে, তাদের অংশগ্রহণ থাকাটা জরুরি। যখন কোনো নির্বাচনে একটি বড় দল বা অনেকগুলো অংশগ্রহণ না করে, তখন সেই নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য বলার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, “আলোচনা হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। যদি গণতন্ত্র চর্চা করতে চান, তাহলে সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। এই দায়িত্বটা সবার, যদিও প্রধান দায়িত্বটা সরকারি দলের। তাদেরকে উদ্যোগ নিতে হবে, সেই উদ্যোগে অন্যান্য দলকে সাড়া দিতে হবে৷’’
আব্দুল আলীম বলেন, ‘‘২০১৪ সালে যে পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে, এখন নির্বাচনের সেই পরিবেশ বিরাজ করছে। আমার মনে হচ্ছে, একইরকম সহিংসতার দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি; যেটা গণতন্ত্র, দেশ, দেশের মানুষ এবং অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়৷’’
বিএনপি শুরু থেকেই নির্বাচনি কার্যক্রম বয়কট করছে জানিয়ে আব্দুল আলীম বলেন, বিএনপি এই নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বাস করছে না। সাংবিধানিকভাবে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে ইসিকে নির্বাচন করতে হবে। পৃথিবীতে অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে সংবিধান কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না যদি রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় আসে। ১৯৯১ সালে সমঝোতার মাধ্যমে তত্ত্ববধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল, সেটি সংবিধান বা আইনের কোথাও উল্লেখ ছিল না। দলগুলো যদি এক জায়গায় বসে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে আসে, তাহলে সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।
রাজনৈতিক সমঝোতা হলে নির্বাচনের পরিবেশ বদলাতে পারে- এম মত প্রকাশ করে আব্দুল আলীম বলেন, ‘‘জানুয়ারির প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচন করতে চায় কমিশন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তফসিল রিভাইজ করা হয়েছিল, সেটা এই কমিশনও চাইলে করতে পারে৷’
এসএইচ-০৩/১২/২৩ (শহীদুল ইসলাম, ডয়চে ভেলে)