চাপকে পাশে ঠেলে নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে আ’লীগ!
নির্বাচন নিয়ে অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ চাপকে পাশে ঠেলে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার। কোন ধরণের রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের আশংকা করছেন অনেকে।
যদিও তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের, তবে ‘যথাসময়ে’ তফসিল ঘোষণা এবং নির্বাচনের বিষয়ে কমিশন এবং সরকার একই সুরে কথা বলেছে। অতীতেও বিভিন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেটা দেখা গিয়েছিল।
২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছিল দেশে-বিদেশে। সেজন্য এবার বেশ আগে থেকেই আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন সময় অবাধ,সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছিল।
বিএনপি এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোও ক্রমাগত বলেছে যে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। সেজন্য তারা আন্দোলনও করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সমঝোতার চেষ্টা ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বরাবরই ভারতের ইতিবাচক দৃষ্টি ছিল। গত ১৫ বছরে সেটি প্রতিষ্ঠিত সত্য বলে অনেকে পর্যবেক্ষক মনে করেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এ দফায় ভারত প্রকাশ্যে কোন তৎপরতা না দেখালেও কূটনৈতিকভাবে তারা থেমে ছিল না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সর্বশেষ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকে সেটি প্রকাশ্যে এসেছে।
বৈঠক শেষে ভারতের বিদেশ সচিব ভিনয় কোয়াত্রা সাংবাদিকদের বলেন – একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে সেদেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ‘ভিশন’কে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে।
তিনি এটাও বলেছেন, “বাংলাদেশের নির্বাচন সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সেদেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।“
ভারতের এ দৃষ্টিভঙ্গি নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সহায়তা করেছে কী না?
“ভারতের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন তো আছেই। এবং এটা খুব স্বাভাবিক,” বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।
কবির বলছেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে ভারত পরিষ্কার করে দিয়েছে যে তারা কাদের ‘প্রগ্রেসিভ’ মনে করে। যদিও এটাতে কতটা সারবত্তা আছে সেটা ভিন্ন কথা।
“এখনকার দৃশ্যমান প্রেক্ষাপটে তারা প্রগ্রেসিভ বলতে লেফট অব দ্য সেন্টার পলিটিক্স যারা করে তাদেরকে বোঝায়। সেটা আওয়ামী লীগ বলেন, জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পাটি বলেন – তাদের যে কম্বিনেশন আছে সেটাকেই তারা ইঙ্গিত করে।”
ভারত ফ্যাক্টরের বিষয়টি অস্বীকার করছেন না আওয়ামী লীগ নেতারাও।
দলটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং নির্বাচনে ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ড. সেলিম মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে আছে।
তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সরকারের ধারাবাহিকতা থাকার কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতেও শান্তি বিরাজ করেছে।
“ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের উপর যে কোন ধরণের বিদেশি হস্তক্ষেপ ভারতের উপরও বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।”
ভারতের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষমতাসীনদের সহায়তা করেছে বলে উল্লেখ করেন ড. মাহমুদ।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা অতীতে বিভিন্ন সময় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভারত তাদের ‘পাশে আছে’।
অক্টোবর মাসের শুরুতে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন “তলে তলে আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে, আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। দিল্লি আছে আমরা আছি।”
তার সেই বক্তব্য বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এছাড়া গত বছর অগাস্ট মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের আরেকটি বক্তব্য বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।
তিনি বলেছিলেন, “আমি ভারতে গিয়ে যেটি বলেছি যে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।”
নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে ভিসা নীতি প্রয়োগ করার হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, এ বিষয়টি খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
“আমেরিকার ভিসা স্যাংশন নীতি থেকে যে ভীতির আশংকা করা হয়েছিল, সেটা অনেকটাই কেটে গেছে,” বলেন আহমদ।
নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে বিরোধী দলের রাজনৈতিক দুর্বলতা। এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পরেও বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ফলে নির্বাচন নিয়ে কোন কোন সমঝোতার পথে হাটার প্রয়োজন অনুভব করেনি সরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, সরকার জনগণের চাপ উপেক্ষা করছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সঙ্গে নিয়ে।
“বাইরের চাপটা তারা অতোটা তোয়াক্কা করছে না। বাইরের চাপ নিয়ে তারা অতোটা মাথায় ঘামায় বলে মনে হয়না। … তারা যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় থাকবে,” বলেন মি. আহমদ।
তার মতে, বিরোধী দল সরকারের উপর তেমন কোন রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারেনি এবং ২০১৪ সালের তুলনায় সরকার এখন অনেকটা ‘স্বস্তি-দায়ক অবস্থায়’ আছে।
“সরকার নানাভাবে বিএনপিকে আইসোলেট করতে পেরেছে,” বলেন মি. আহমদ।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার ফলে ক্ষমতার কাঠামোর সাথে তাদের একটা ‘গভীর সম্পর্ক’ তৈরি হয়েছে।
মহিউদ্দিন আহমদের মতো একই ধারণা সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের।
“রাজনৈতিকভাবে তারা যে সংগঠিত এটা তো সত্যি কথা। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো আছে এবং পাশাপাশি প্রশাসনিক কাঠামো মোটামোটি তাদের পক্ষে,” বলেন মি. কবির।
“সে কারণেই আমার ধারণা, তারা এটা মনে করে, অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন করে তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা বা তাদের কাছ থেকে দাবি আদায় করাটা, সেটা এখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্যদের পক্ষে করাটা কঠিন।
গত তিন সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ দ্রুত বদলেছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় রাজনৈতিক সহিংসতা। সে ঘটনার পর বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়েছে। ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা হয়তো কারাগারে নয়তো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিরোধী দলকে কোণঠাসা করার জন্য ২৮ শে অক্টোবরের ঘটনা সরকারের সরকারের হাতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
“বিএনপি যে নাশকতা করেছে সেটি সারা পৃথিবী দেখেছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যকে পিটিয়ে মেরেছে। প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলা হয়েছে, হাসপাতালে হামলা হয়েছে। আমরা এ বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেছি,” বলেন ড. সেলিম মাহমুদ।
২৮শে অক্টোবর বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে ঢাকায় জড়ো হয়েছিল। সংঘাত শুরুর পর পুলিশ যেভাবে তাদের রাস্তা থেকে হটিয়ে দিয়েছে সেটি ক্ষমতাসীনদের মনে বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
“আমার মনে হয়, সরকারের পাতা ফাঁদে বিএনপি পা দিয়েছে। বিএনপি মোমেন্টাম ধরে রাখতে পারেনি। সমাবেশ ভেঙ্গে দেয়া সরকারকে কনফিডেন্স দিয়েছে,” বলছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, “এ ধরণের সিচুয়েশনে অনেকে অনেক কিছু করে। অনেককে দিয়ে অনেক কিছু করানো হয়। বাংলাদেশে এর আগেও সে রকম হয়েছে। কিন্তু পুরো দায়টা পড়েছে বিএনপির উপরে।”
“ এখানে বিরোধী দলও কিছুটায় অসুবিধায় আছে। কারণ, নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিলে তারা আমেরিকার ভিসা স্যাংশনের খপ্পরে পড়ে যাবে। সুতরাং এটা তাদের জন্য একটা সংকট। সেজন্য এটাকেও একটা সুবিধা বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার,” বলেন আহমদ।
২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে আওয়ামী লীগ তাদের উন্নয়ন তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসে। গত কয়েক মাস ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একের পর এক মেগা প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন। যদিও এর মধ্যে কিছু প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।নির্বাচনকে সামনে রেখেই যে এসব উদ্বোধন করা হয়েছে সেটি অনেকটাই পরিষ্কার।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, এসব অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প রাজনৈতিকভাবে সুবিধা দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও এসব উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে নানা অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে।
২০১৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতাল এবং অবরোধের মতো কর্মসূচী ছিল না। ক্ষমতাসীন দলের নানা ধরণের নীতি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তর সমালোচনা থাকলেও রাস্তায় সেটির প্রতিফলন দেখা যায়নি।
সেজন্য বিরোধী দল হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচী দিয়ে বিরোধী দল খুব বেশি দিন সুবিধা করতে পারবে না বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের বদ্ধমূল ধারণা।
ড. সেলিম মাহমুদ বলছেন, আওয়ামী লীগ গত এক দশক যাবত দেশে স্থিতিশীলতা তৈরি করতে পেরেছে।ফলে অবকাঠামোর উন্নয়নও হয়েছে।
ভারতের সমর্থন কিংবা বিরোধী দলের দুর্বলতা – এসব কিছুর বাইরেও অবকাঠামোর উন্নয়ন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের দিকে যেতে সহায়তা করেছে।
“আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি এ দেশের জনগণ,” বলছিলেন মি. মাহমুদ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাচ্ছে।
“এই যে এখন সবকিছু রেডি হওয়ার আগেই উদ্বোধন হচ্ছে।প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে প্রচুর। মানুষ তো এগুলো দেখছে”
“এই যে সুন্দর সুন্দর স্থাপনা.. এগুলো যে প্রক্রিয়াতেই হোক, অভিযোগ যতই থাকুক। সরকার তো এই সুযোগটাও নিচ্ছে যে এগুলো আমরা না থাকলে হতো না। আগে তো হয় নাই এগুলো,” বলেন আহমদ।
এসএইচ-০৪/১৭/২৩ (অনলাইন ডেস্ক সূত্র : বিবিসি)