জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল-পর্ব সবে শেষ হয়েছে৷ এরই মাঝে আসতে শুরু করেছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের নানা ধরনের অভিযোগ৷
বিশ্লেষকরা বলছেন এবার শুরুতেই এত আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণ ক্ষমতার দাপট৷ যারা লঙ্ঘন করেছেন তাদের অধিকাংশই শাসক দলের৷
আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের তালিকায় একজন মন্ত্রী, তিন প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ আরো অনেকে আছেন৷ আচরনবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রশ্ন করায় চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী একজন সাংবাদিককে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ নির্বাচন কমিশন মোট ২২ জনকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে৷ যারা আচরণ বিধি লঙ্ঘনের নোটিশ পেয়েছেন তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলে জানা গেছে৷
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, নাটোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এবং ঢাকা-১৯ আসনের সংসদ সদস্য ডা. মো. এনামুর রহমান ও ক্রিকেটার এবং মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাকিব আল হাসানকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে শুক্রবার বিকেলের মধ্যে সশরীরে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছে নির্বাচন কমিশন৷
পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি ব্যানার ও ফেষ্টুনসহ শোভাযাত্রা এবং সশস্ত্র ব্যক্তিদের নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন৷ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও মাগুরা-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাকিব আল হাসান বুধবার গাড়িবহর নিয়ে মাগুরা শহরে প্রবেশ করার পর এক নাগরিক সংবর্ধনায় অংশ নেন৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বহর নিয়ে ঢাকা-১৯ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন৷ ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী আড়াই শতাধিক মাইক্রোবাস ও দুই শতাধিক মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে ভাঙ্গার দত্তপাড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন৷ এতে ওই সব এলাকায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷
আরো যাদের কাছে আচরণবিধি ভঙ্গের কারণে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন- লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী নূর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য মিয়া মো. গোলাম ফারুক পিংকু, নরসিংদী-৫ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ, পটুয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মহিববুর রহমান, রংপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তুষার কান্তি মন্ডল, গাজীপুর-৫ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও প্রার্থী মেহের আফরোজ (চুমকি), সুনামগঞ্জ-৪ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও দলটির প্রার্থী পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, ঢাকা-৬ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও দলটির মনোনীত প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ, গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. আনোয়ার হোসেন খান, মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস; ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ময়মনসিংহ-১১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজিম উদ্দিন আহম্মেদ ধনু, নাটোর-২ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শফিকুল ইসলাম শিমুল, বরিশাল-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপু এবং চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী৷
আচরণবিধি যা বলছে
নির্বাচনের আচরণবিধি অনুযায়ী, নির্বাচনের প্রচার শুরুর দিন না আসা পর্যন্ত পোষ্টার, ব্যানার লাগানো বা দল বেঁধে মিছিল করা যাবে না৷ কোনো মিছিল বা শো-ডাউন করে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যাবে না৷ করা যাবে না কোনো শোভাযাত্রা৷ একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ পাঁচজনকে নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবে ন৷ আর প্রচার শুরু হলে তা কীভাবে করতে হবে তারও নীতিমালা আছে৷
নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিল শেষ হয়েছে৷ শুক্রবার থেকে বাছাই শুরু হয়েছে৷ চলবে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত৷ রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ও শুনানি ৬-১৫ ডিসেম্বর এবং ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে এবং ওইদিন প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হবে৷ প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে ১৮ ডিসেম্বর৷ নির্বাচনি প্রচার চলবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত৷ ৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ৷ তাই ১৮ ডিসেম্বরের আগে কোনো ধরনের কোনো প্রচার চালালে তা হবে আচরণবিধি লঙ্ঘন৷
আচরণবিধি ভঙ্গের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, কিছু কিছু জায়গায় প্রার্থীদের কার্যক্রমে মনে হয়েছে যে, আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে৷ সে ক্ষেত্রে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটিগুলো অনেকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে এবং তারা তাদের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে৷ এ ছাড়া রিটার্নিং অফিসারদের মাধ্যমে আচরণবিধি নিশ্চিত করণের দায়িত্বে নিয়োজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও কাজ করছেন৷
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমূল্লাহ বলেন, ‘‘আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ক্ষমতার দাপট একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে৷ আর সবাই ধরে নিয়েছেন এটা তো সময়ের ব্যাপার৷ সুতরাং অবধারিতভাবে যা হতে চলেছে, তা আগেই জানান দিয়ে দেয়া ভালো৷ মাইট ইজ রাইট৷’’
তার কথা, ‘‘নির্বাচন কমিশন আগে সতর্কতা জারি করলেও যে তাতে খুব একটা কাজ হতো তা মনে হয় না৷ আগেও তো কাজ হয়নি৷ এখন যে ২২ জনকে শোকজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কতটা কঠোর ব্যবস্থা নেয় তা না দেখে বলা যাবে না৷’’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে শাস্তি হিসেবে প্রার্থীতা বাতিল পর্যন্ত হতে পারে৷ কিন্তু সাধারসত সতর্ক করা বা জরিমানা করার চেয়ে বড় শাস্তি নির্বাচন কমিশন দেয় না৷ ফলে যারা ক্ষমতাবান, তারা জেনেশুনেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন৷ আপনি খেয়াল করবেন, যারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের৷ আমাদের সময়ে আমরা তিন জনের প্রার্থীতা আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে বাতিল করেছিলাম৷ কিন্তু আমাদের ওপরে আদালত আছে৷ তারা আদালত থেকে প্রার্থীতা ফিরে পান৷’’
তার কথা, ‘‘নির্বাচন কমিশন আগে থেকেই কঠোর হলে হয়ত বা আচরণবিধি লঙ্ঘন কিছুটা কম হতো৷ কিন্তু আমি শুনেছি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তারা তো এখনো প্রার্থী হননি, প্রার্থী হওয়ার আগে তাদের ব্যাপারে কিছু করার নেই৷ তিনি আসলে আইনের অপব্যাখ্যা দিয়েছেন৷’’
‘‘আর পুলিশ প্রশাসনেরও দায়িত্ব আছে৷ কিন্তু তাদের কি সেই সাহস আছে যে প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘন থেকে নিবৃত্ত করবে?’’ প্রশ্ন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারের৷
ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম শুক্রবার বলেন, ‘‘আমরা নির্বাচনে আচরণবিধি দেখার জন্য ৩০০ আসনে ৩০০ কমিটি করেছি৷ এই কমিটির প্রধান হলেন যুগ্ম জেলা জজ এবং সহকারি ও সিনিয়ন সহকারি জজ৷ কোনো আসনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তারাই শোকজ করবেন, ব্যাখ্যা নেবেন ন৷ এটা মূলত তাদেরই কাজ৷ রিটার্নিং অফিসার সিদ্ধান্ত নেবেন৷’’
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের জেল, ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে৷ আবার আরপিওতে আছে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত জেল জরিমানা, দণ্ড৷ এটা অপরাধের ধরনের ওপর নির্ভর করে৷’’
এসএইচ-০১/০১/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)