জাপাসহ জোটসঙ্গিরা আ’লীগের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়!

জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদসহ কয়েকটি দল এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন বা দলীয় প্রতীক পাবেন কিনা এনিয়ে দলগুলোর মধ্যে নানা হিসেব-নিকেশ চলছে।

তবে ক্ষমতাসীন দলটির গত দেড় দশকের মিত্র এসব দলগুলো আশা করছে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচনী সমঝোতার উদ্যোগ নেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

যদিও জাতীয় পার্টির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন যে সমঝোতা না হলেও তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা চাইবেন এবং সেটি পেলে সরকার বিরোধী ভোট পেয়েই তাদের প্রার্থীরা অনায়াসে বিজয়ী হতে পারবে বলে আশা করছেন তারা।

দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলছেন নির্বাচন নিয়ে সরকারি দলের তাদের কোন যোগাযোগ বা কথাবার্তা হয়নি এবং হওয়ার কোন সম্ভাবনাও আছে বলে তিনি মনে করেন না।

“আমরা তা নিয়ে ভাবছিও না। বরং ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে আসতে পারলে সরকার বিরোধী ভোট পেয়ে আমরা আগের চেয়ে ভালো করবো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন অবশ্য বলছেন নৌকা প্রতীক বা আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া নানা কারণেই নির্বাচন হবে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জের।

তবে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু জানিয়েছেন খুব শিগগিরই আওয়ামী লীগের সাথে জাসদসহ জোটবদ্ধ দলগুলোর আলোচনা হবে এবং জোট প্রার্থী হিসেবে তারা নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবেন।

এছাড়া জেপি ও বিকল্প ধারার মতো দলগুলোর, যাদের একাদশ সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিলো তারাও এখন তাকিয়ে আছে সরকারি দলের সিদ্ধান্তের দিকেই।

যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বিষয়টি দলীয় সভানেত্রীর হাতে উল্লেখ করে এসব বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের মধ্যে জাসদ, জেপি, তরিকত ফেডারেশন ও ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচনী রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও এবার আওয়ামী লীগ এককভাবেই ২৯৮ টি আসনে তাদের প্রার্থী দিয়েছে। কুষ্টিয়া-২ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রার্থী দেয়নি দলটি।

গত তিনটি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হওয়া ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের ঢাকা-৮ আসনে আওয়ামী লীগ দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমকে মনোনয়ন দেয়ার পর মি. খান এই আসনে মনোনয়ন পত্রই দাখিল করেননি।

এর পরিবর্তে বরিশাল-২ ও ৩ আসনে মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন তিনি। কিন্তু ওই দুটি আসনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে। এছাড়া দলটির কয়েকজন উভয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছেন।

“নির্বাচনে অস্ত্র, পেশীশক্তি ও প্রশাসনের ব্যাপার আছে। আওয়ামী লীগ সরকারি দল এবং তাদের লোকজনও আছে। তাদের সমর্থন ছাড়া আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাশেদ খান মেনন।

বরাবরই নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া রাশেদ খান মেনন জানিয়েছেন আগের নির্বাচনী জোট থাকবে কি-না অর্থাৎ তিনিসহ তার দলের আগের এমপিরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন কি-না সে বিষয়ে সরকারি দলের পক্ষ থেকে কোন ইঙ্গিত তারা এখনো পাননি।

অন্যদিকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিলেও আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে রেখেছেন।

আবার জাসদের আরেক এমপি শিরিন আখতারের ফেনী-১ আসনে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন দলটির নেতা আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম।

এছাড়া আওয়ামী লীগের আরেক দীর্ঘকালীন মিত্র জেপি’র একমাত্র সংসদ সদস্য দলটির সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।

তাঁর পিরোজপুর-২ আসনে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বিশ্বাস।

ফলে এসব আসনে জোট নেতারা সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কতটা সুবিধা নিতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় আছে এসব দলের ভেতরেই।

যদিও হাসানুল হক ইনু বলেছেন দ্রুতই এসব বিষয়ে সমাধান হবে জোটের মধ্যে।

পরপর তিনটি নির্বাচন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বিকল্প ধারা, তরিকত ফেডারেশনের মতো দলগুলো সহজেই সংসদে আসন পেলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।

আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে প্রার্থী দেয়ায় জোটের এসব দলগুলো কীভাবে অংশ নিবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।

এবার হাসানুল হক ইনুসহ জাসদের ৯১ জন, রাশেদ খান মেননসহ ওয়ার্কার্স পার্টির ৩৩ জন, বিকল্প ধারার ১৪ জন, তরিকত ফেডারেশনের ৪৭ জন বিভিন্ন আসনে প্রার্থী হয়েছেন।

কিন্তু নৌকা প্রতীক অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেলে এসব প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে কতটা সুবিধা করতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় আছে।

তবে হাসানুল হক ইনু পরিষ্কার করে বলেছেন যে এবারো তারা আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধভাবেই নির্বাচন করবেন। “শিগগিরই বৈঠক করে এগুলো নিরসন করা হবে। জোট নেত্রী এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনকেও জানিয়েছেন বিষয়টি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আবার জাতীয় পার্টি ২৮৬ আসনে প্রার্থী দিলেও আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারানোর সক্ষমতা তাদের কতজনের আছে তা নিয়েও নানা আলোচনা আছে।

দলটির কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার বলছেন, “এমন সংকট নিয়ে আমি দ্বিমত করছি না। তবে এখনো আলোচনায় বসলে অনেক কিছুরই সম্ভাবনা আছে। সব নির্ভর করে মহাজোট নেত্রীর ওপর। দেখি সামনে কী হয়”।

যদিও দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গোলাম মাসরুর মাওলা বলছেন সমর্থন না দিলে সমস্যা নেই কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দরকার।

“নির্বাচন ভালো হলে আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোট আমরাই পাবো,” বলছিলেন তিনি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে নিজেদের জন্য ২৬৪টি আসন রেখে বাকী আসনগুলোতে বাকি আসনগুলো জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ।

কিছু আসন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি উভয়ের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছিলো। সে কারণে জাতীয় পার্টি মোট ৪৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৭টিতে বিজয়ী হতে পেরেছিলো।

অন্যদিকে জাসদের তিনজন ও ওয়ার্কার্স পার্টির দুজন নৌকা প্রতীক নিয়েই বিজয়ী হয়েছিলো।

মূলত ২০০৬ সাল থেকে বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে মহাজোট গড়ে উঠেছিলো তার আলোকেই আসন সমঝোতা করে তখন নির্বাচনে গিয়েছিলো আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনে একাই ২৩০ আসনে জিতে সরকার গঠন করেছিলো আওয়ামী লীগ। সেবার জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরকে মন্ত্রীও করা হয়েছিলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে।

২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ বিরোধীরা বর্জন করেছিলো। ওই নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছিলো।

এ নির্বাচনেও সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে গেলেও পরে বিরোধী দল থেকেও কয়েকজন সরকারের মন্ত্রী হন। মন্ত্রী করা হয় রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুকেও।

ওই সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে ওয়ার্কার্স পার্টির ছয় জন, জাসদের পাঁচ, জেপির দুই জন এবং তরিকত ফেডারেশন ও বিএনএফ এর একজন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।

এরপর ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট অংশ নিলেও এ নির্বাচনেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২৬৬ আসনে, জাতীয় পার্টি ২২ আসনে এবং বিএনপি জোট ৭টি আসনে জয়ী। আর চারটি আসনে স্বতন্ত্র পেয়েছিলো।

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোট হিসেবে ১৪ দলীয় জোটের দলগুলোর মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়ে জাসদ ২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, বিকল্প ধারা ২টি, তরীকত ফেডারেশন ১টি আসনে জিতেছিলো৷

এর বাইরে জেপি বাইসাইকেল প্রতীক নিয়ে একটি আসনে জিতেছিলো।

এসএইচ-০২/০১/২৩ (রাকিব হাসনাত,বিবিসি)