বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত কী অবস্থান নেয়, সেদিকে নজর ছিল সবারই। নভেম্বর মাসের যেদিন ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ঘোষণা করে দিলেন যে দিল্লিতে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সচিবদের সামনে নিজেদের স্পষ্ট অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে তারা- বাংলাদেশের মানুষই স্থির করবেন যে সে দেশে নির্বাচন কীভাবে হবে, তখনই দেশটির অবস্থান বোঝা গিয়েছিল যে চিরাচরিত মিত্রের পেছনেই দাঁড়াচ্ছে তারা।
তাই আওয়ামী লীগ বিপুল আসনে জয়ী হওয়ার পরে প্রথম যে কয়েকজন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের ফোন আসবে ঢাকায়, তাদের মধ্যে যে নরেন্দ্র মোদীর নাম থাকবে, সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরে মি. মোদী তার এক্স (আগেকার টুইটার) হ্যান্ডেলে লিখেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বললাম এবং সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থ বারের মতো ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করায় তাকে অভিনন্দন জানালাম।”
বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান অংশীদারিত্ব আরও দৃঢ় করার বার্তাও দিয়েছেন মোদী।
বিশ্লেষকরা বলছেন আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে সবসময়ই ভারত স্বস্তিতে থাকে। ভারত আর আওয়ামী লীগের মধ্যে সুসম্পর্ক যেমন ঐতিহাসিকভাবে থেকেছে, তেমনই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার গত দেড় দশকে তা আরও দৃঢ় হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ভিনা সিক্রি বলছিলেন, “দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যদি একটা ধারাবাহিকতা থাকে তাহলে অংশীদারিত্ব জোরদার হয়। আর ভারত সবসময়ই চাইবে যে প্রতিবেশী দেশগুলিতে একটা স্থিতিশীল সরকার থাকুক।
“এর ফলে কূটনৈতিক সম্পর্ক বলুন বা বাণিজ্য অথবা যৌথ প্রকল্পগুলি– সব ক্ষেত্রেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হয়। দুই দেশই লাভবান হবে, এরকম অনেকগুলি যৌথ প্রকল্প তো চলছে, শেখ হাসিনা আবারও জিতে আসাটা তাই ভারতের দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল,” বলছিলেন মিসেস সিক্রি।
সেই বার্তাটাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিয়েছেন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পরেই।
সিক্রির কথায়, নির্বাচনের এই ফলাফল ভারতের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকেও বড় বিষয় হলো যে ‘বাংলাদেশের মানুষই তো ভোট দিয়ে শেখ হাসিনাকে আবারও ফিরিয়ে এনেছেন’।
এই প্রসঙ্গে তার কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় যে ভোটদানের হার তো বেশ কমই ছিল, মিসেস সিক্রি বলেন, “বাংলাদেশে যে বিপুল হারে ভোট পড়েছে তা বলবো না। কিন্তু বহু দেশেই এরকম অথবা আরও কম হারে ভোট পড়ে থাকে। তাই এটা অস্বাভাবিক কিছু বলে আমি মনে করি না।”
ভারতের উত্তর পূর্বের অধিকাংশ রাজ্যের সঙ্গেই বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। এই অঞ্চলে একসময়ে আসামের আলফা বা ত্রিপুরার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির মতো অনেক সংগঠনই বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়েছিল বলে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করতো, কিন্তু বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকার তা মানতে চাইতো না।
ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ২০০৭ সালে উত্তর পূর্ব ভারতের ১১২ জন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা-নেত্রীর একটি তালিকা তুলে দিয়েছিল বাংলাদেশের হাতে, যারা সেসময়ে সেদেশে অবস্থান করছিলেন। আরেকটি পৃথক তালিকা দেওয়া হয়েছিল বিএসএফের পক্ষ থেকে যেখানে ১৭২টি শিবিরের উল্লেখ ছিল, যেগুলি উত্তর পূর্ব ভারতের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলি পরিচালনা করে বলে বিএসএফ দাবি করেছিল।
আবার মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুরনো শিবিরগুলিতে পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই যাতায়াত করছে আর তাদের মধ্যে থেকে নিয়োগের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এমন একটি তালিকাও বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছিল বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ অফিসার। তিনি বলেছিলেন যে নির্দিষ্ট কোঅর্ডিনেট দিয়ে বাংলাদেশের এক প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে যে কোথায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে গুপ্তচর নিয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছে আইএসআই।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন আগে ভারতের পক্ষ থেকে বার বার এই বিষয়গুলি তোলা হলেও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে চিত্রটা সম্পূর্ণ বদলে যায়।
ভারতের এলিট কমান্ডো বাহিনী এনএসজির অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক দীপাঞ্জন চক্রবর্তী বলছিলেন, “উত্তর পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আর জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির যেসব তৎপরতা একসময়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে চলত, সেসব তো শেখ হাসিনা বন্ধ করেছিলেনই, আর সেই অবস্থাটা বজায় রাখার জন্য শেখ হাসিনার নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসা খুবই জরুরি ছিল।”
“এছাড়াও নিয়মিতভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে ভারতে, সেটা বন্ধ করতে হলেও শেখ হাসিনার সহযোগিতা প্রয়োজন ভারতের। তাই তার নির্বাচনে জিতে ফিরে আসাটা ভারতকে নিরাপত্তা প্রসঙ্গে নিশ্চিতভাবেই অনেকটা স্বস্তি দিয়েছে,” বলছিলেন চক্রবর্তী।
ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার ভিনা সিক্রি বলছিলেন যে বাংলাদেশের দ্বাদশ নির্বাচনে যে সবথেকে বড় বিরোধী দল বিএনপি যোগদান করেনি, সেটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এর জন্য নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না।
তার কথায়, “একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনে কোনও দল অংশ নেবে কী না সেটা সম্পূর্ণভাবেই তাদের সিদ্ধান্ত। যদিও আমি মনে করি যে নির্বাচনে সব দলেরই অংশ নেওয়া উচিত। কিন্তু বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা যোগ দেবে না, যতক্ষণ শেখ হাসিনা সরকারে থাকবেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টিই তো বাংলাদেশের সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে বিষয়টা বাংলাদেশের সংবিধানেই নেই, সেটা কী করে কেউ দাবি করতে পারে?”
“তবে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলেও তাদের দলের জনা তিরিশেক নেতা তো প্রার্থী হয়েছিলেন! আসলে আমার মনে হয় বেগম খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ, তারেক রহমানও বাইরে থাকেন। তাই দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে তৃণমূল স্তরের কর্মীদের মনোভাব ঠিক কতটা ধরতে পেরেছিলেন, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে,” বলছিলেন ভিনা সিক্রি।
দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পগুলি এগিয়ে নিতে বা দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানে পড়শি দেশে ধারাবাহিকতা থাকা যেমন ভারতের স্বার্থেই দরকার, তেমনই ভারত আর বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট থেকেও বিচার করা দরকার বলে মনে করছেন ভারতীয় বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস এক প্রতিবেদনে লিখেছে, “২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ২৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে বাংলাদেশে সব থেকে বড় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসাবে উঠে এসেছে বেইজিং। চীনা ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ তাদের বড় বড় বেশ কয়েকটি প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে পেরেছে।”
“এছাড়াও কয়েক ডজন মহাসড়ক, ২১টি সেতু আর ২৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চীন জড়িত রয়েছে,” লেখা হয়েছে হিন্দুস্তান টাইমসের ওই প্রতিবেদনে।
বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ছাড়াও বাংলাদেশকে সামরিক সহায়তাও দিয়ে থাকে চীন।
কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী বলছিলেন, “সম্প্রতি বাংলাদেশে যেভাবে চীনের উপস্থিতি বেড়েছে, যেভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা এসেছে বাংলাদেশে, সেদিক থেকে দেখলে চীন সেখানে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী। চতুর্থবার ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা সরকারের আমলে চীনা সহায়তাকে ঘিরে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভারত কতটা তার মোকাবিলা করতে পারে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
নির্বাচনের আগে থেকেই বাংলাদেশের মানুষের একাংশের মধ্যে একটা ভারত বিরোধী ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে খোলাখুলিই লিখেছেন যে ভারতের ইচ্ছা বলেই নির্বাচন নিয়ে অনড় অবস্থান নিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছেন শেখ হাসিনা।
অবশ্য এই ক্ষোভ এবারের নির্বাচনের আগে যে নতুন করে দেখা যাচ্ছে, তা নয়। বিগত নির্বাচনগুলির আগে-পরে, ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের একাংশের মানুষকে বিষোদ্গার করতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে।
অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী বলছেন যে, কোনও দেশের সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের একাংশের ক্ষোভ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
“ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সময়মতো যদি রক্ষিত না হয়, তা হলে জটিলতা তো দেখা দেবেই। বাংলাদেশের মানুষের মনে তখনই প্রশ্ন ওঠা অসঙ্গত নয় যে ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ফলে তারা কতটা লাভবান হলেন বা হতে পারেন। এই প্রশ্নও তাদের মনে ওঠা স্বাভাবিক যে আদৌ তারা লাভবান হবেন তো?”
“বাংলাদেশের মানুষের একাংশের মনে সেই প্রশ্ন যাতে না ওঠে, তার জন্য ভারতকে আরও সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে। এইসব প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে একটা বড় বিষয় তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর জল বণ্টন ব্যবস্থা দ্রুত সম্পন্ন করা,” বলছিলেন অধ্যাপক বসু রায়চৌধুরী।
এসএইচ-০২/১১/২৪ (অমিতাভ ভট্টশালী,বিবিসি)