এবার ভোটযুদ্ধে ফিরল বাংলাদেশ!

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হচ্ছে আজ। এর মধ্য দিয়ে মাঠে গড়াবে ভোটের লড়াই। ভোটারের মন জয়ের এই প্রতিযোগিতার ফল মিলবে ৩০ ডিসেম্বর।

দর-কষাকষি শেষ করে বড় দুই দল ও জোট ৩০০ আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করতে রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত সময় নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা নিয়ে বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দাবি জানিয়ে আসছে। তবে রোববার পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। সবার জন্য সমান সুযোগের পরীক্ষা শুরু হবে আজ থেকে। অবশ্য নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। ১০ বছর পর ভোটযুদ্ধ ফিরে আসল দেশে। এখন ভোটারদের ভোট-উৎসবে শামিল করা দলগুলোর দায়িত্ব। এতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে এই নির্বাচন কিছুটা আলাদা। এক দশক পর সব দলমতের মানুষ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আবার ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন হয়েছে (১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাড়া) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এবারই দলীয় সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলেও সব দল তাতে অংশ নেয়নি। বিতর্ক ও বিরোধিতা সত্ত্বেও এই নির্বাচনে জাতীয় সংসদ বহাল থাকছে। সরকারি জোটের সাংসদেরা স্বপদে থেকেই নির্বাচন করছেন।

এ নির্বাচনের আরও বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্যতম বড় দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারছেন না। দণ্ডিত হয়ে তিনি কারাগারে। তাঁর ছেলে দলে দ্বিতীয় শীর্ষ নেতাও দণ্ডিত, তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন এবং নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না।

নিজেদের মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলামী। দলটির নিবন্ধনও নেই। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটি শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তাই এবার জামায়াতের নেতারা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

নির্বাচনী বৈশিষ্ট্যে নতুন সংযোজন ইভিএম। বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও এই প্রথম জাতীয় নির্বাচনে সীমিত আকারে ইভিএমের ব্যবহার হচ্ছে। ছয়টি আসনে পুরোপুরি ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হবে।

এবার ভোট সামনে রেখে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত রাজনীতি জোটের আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে। নিবন্ধিত দল ৩৯টি হলেও নির্বাচনের বাজারে অন্তত ১৬টি জোট ও ২৮০ দলের নাম পাওয়া গেছে। কার সঙ্গে কত দল ও জোট আছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তা দেখানোর প্রতিযোগিতায় নামায় ডান, বাম, মধ্যপন্থী, ধর্মাশ্রয়ীসহ ছোট-বড়, নামসর্বস্ব অনেক দল গুরুত্ব পেয়েছে, আলোচনায় এসেছে। আওয়ামী লীগের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে স্বৈরশাসক এরশাদের দল জাতীয় পার্টি। বিএনপির কাছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত। বিএনপি তাদের ভোটের মাঠ রেখেছে জোটের আবরণে। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সে আড়ালকে আরও পুরু করেছে।

মনোনয়নপত্র দাখিলেও এবার রেকর্ড হয়েছে। ৩০০ আসনে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে ৩ হাজার ৬৫। বাছাইয়ে বাতিল হয়েছে ৭৮৬টি। এরমধ্যে নির্বাচন কমিশনের আপিলে বৈধ হয়েছে ২৪১ জনের মনোনয়নপত্র। বিএনপি ৩০০ আসনে ৬৯৬ জনকে মনোনয়নের চিঠি দিয়েছে। জোটের সঙ্গে সমঝোতা করে দলটিকে একক প্রার্থী দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। গতকাল শেষ দিনেও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের সমর্থকেরা বিক্ষোভ করেছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিদের অনেকে যাঁর যাঁর এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ‘বিদ্রোহী’দের বসাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি চিঠি পর্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

বড় দুই দল ও জোটের প্রার্থী তালিকায় এবার তেমন চমক নেই। পুরোনোদের পাল্লাই ভারী। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা আইনি কারণে বিতর্কিত ব্যক্তিদের কেউ কেউ বাদ পড়লেও তাঁদের জায়গায় স্ত্রী, সন্তান, বাবা বা অন্য কোনো স্বজন মনোনয়ন পেয়েছেন। নারী ও তরুণ প্রার্থীর সংখ্যা কম। যদিও এবারই সবচেয়ে বেশি, ২ কোটি ৪০ লাখ তরুণ ভোটার প্রথম ভোট দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা মোট ভোটারের ২২ শতাংশ। এবার ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন অনুষঙ্গ হয়েছে কথিত ‘গায়েবি মামলা’। বিএনপির অভিযোগ অনুযায়ী, সারা দেশে চার হাজারের বেশি গায়েবি মামলা হয়েছে। তাই ভোটের আগে ও ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কী হয়, তা এখন বিএনপির কাছে বড় শঙ্কার বিষয়। নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় আছে। এর আগে পাঁচ সিটি করপোরেশনে ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ করে সমালোচিত হয়েছে নির্বাচন কমিশন। জাতীয় নির্বাচনেও একই ‘মডেল’ অনুসরণ করা হয় কি না, তা নিয়েও আলোচনা আছে। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ওপর আস্থা রাখার আশ্বাস দিয়েছেন।

মুখে ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার কথা বললেও এ নির্বাচন আসলে বিএনপির জন্য অনেকটা অস্তিত্বের লড়াই। আর আওয়ামী লীগ বলছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা। ক্ষমতায় থেকে ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চায় আওয়ামী লীগ।

বিএ-০১/১০-১২ (ন্যাশনাল ডেস্ক, তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)