নির্বাচন নিয়ে তৃতীয় কোনো শক্তির ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার তাগিদ দিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। বৃহস্পতিবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। একই সঙ্গে সিইসি ভোটের ভাগ্য যাতে মাস্তান-সন্ত্রাসীদের হাতে চলে না যায়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন।
সিইসির সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সব জেলা পুলিশ সুপার (এসপি), সব জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেন, পেছনের একটা ঘটনার রেশ টানা প্রয়োজন। সেটি হলো ২০১৪ সালের নির্বাচন। সেই নির্বাচনের অবস্থা ভুলে গেলে চলবে না। তখন ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঘটনার আলোকে এবারের নির্বাচন প্রস্তুতির রূপরেখা ও কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ‘তখন মাঠে সব বাহিনী ছিল। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ছিল। তবুও আমরা কী দেখেছিলাম! পুলিশ সদস্য, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট ও শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত হয়েছে। সেটার কী পরিপ্রেক্ষিত ছিল, আমরা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি; সে প্রসঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ ও প্রয়োজন নেই। তবে ভবিষ্যতে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে। এটি ভুলে গেলে চলবে না।’
সেই অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায়, তা ভাবা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘সে রকম কোনো পাঁয়তারা যাতে না হয়। আবার যাতে সে রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আপনাদের দায়িত্ব জনগণের জীবন রক্ষা করা, মালামাল রক্ষা করা, সম্পদ রক্ষা ও দেশের পরিবেশ–পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা।
আমি আশা করব, আপনাদের নিরপেক্ষ ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও মানসিকতা দিয়ে এবারের নির্বাচনে আমরা এসব মোকাবিলা করতে পারব। এ বছর যেন আর সে রকম তাণ্ডব না ঘটে। সে রকম পরিস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি না হয়। এখন থেকে সেটা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে।’
এবারও এমন কিছু ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না—উল্লেখ করে কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘যেদিন প্রতীক বরাদ্দ হলো, তার পরের দিনই দুর্ঘটনা। সে ঘটনাগুলো যত ছোটই হোক না কেন, দুটো জীবন চলে গেল। সে দুটো জীবনের মূল্য অনেক। কিন্তু কেন হলো? তারপর এখানে–ওখানে ভাঙচুর, প্রতিহত করা। এগুলোর পেছনে কি রাজনৈতিক, সামাজিক কারণ? নাকি সেই ২০১৪ সালের মতো ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে?
এগুলো ভালোভাবে নজরে নিতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্ক নজরদারি থাকতে হবে।’ কোনো ঘটনা ঘটে গেলে একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি হালকাভাবে নিলে হবে না। রাজনৈতিক নেতাদের সতর্ক অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে তৃতীয় কোনো শক্তির ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি সতর্ক নজরদারি রাখার অনুরোধ করব।’
সিইসি আরও বলেন, নির্বাচন নিয়ে যখন স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তখনই খুনের ঘটনা, হামলার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এ দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হোক, তা না চাওয়ার দলে প্রভাবশালী মহল সক্রিয় থাকতে পারে। তাদের বিষয়ে সবার বিশেষ করে নির্বাচন কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সমাজের সচেতন মহল ও জনগণের সচেতন থাকা প্রয়োজন।
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘এবার আমরা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করতে চাই। জনগণের ভোট মাস্তানদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। বাক্স ছিনতাইকারীদের হাত থেকে ভোটারদের মুক্তি দিতে হবে। তার প্রথম ও প্রধান যে পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে, সে পদ্ধতির পরিবর্তে আরেকটি পদ্ধতি আনতে হবে। নির্বাচন কমিশন মনে করে, ইভিএম সে রকম একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ভোটারদের ভোটের নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হবে।
আমরা ছয়টি এলাকায় ইভিএম ব্যবহার করতে যাচ্ছি। সে ছয়টি এলাকায় যার যার দায়িত্ব, তাদের অনুরোধ করব আলাদাভাবে দৃষ্টি দিতে, সতর্কতামূলক ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে।’ ইভিএম সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ অনিয়ম দূর হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নির্বাচন–সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ করে সিইসি বলেন, দায়িত্ব পালনকালে পেশাদারি ও নিরপেক্ষতার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে সব বাহিনীর কৌশল ঠিক করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সবচেয়ে বেশি তথ্য-উপাত্ত থাকে। এই তথ্য-উপাত্তগুলো প্রয়োগ করে সব বাহিনীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ছক তৈরি করতে হবে। সব গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক নজরদারি বাড়াতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে এবং এতে বিজিবিকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন হবে। কারণ, এতে তাদের অভিজ্ঞতা আছে।
সিইসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নজরদারি রাখবেন। নারী ভোটারদের নিরাপত্তার বিষয়টিও আলাদাভাবে খেয়াল রাখবেন, যাতে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। প্রত্যেক এলাকার মস্তান ও গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের তালিকা তৈরি করতে হবে, যেটা আপনারা সব সময় করে থাকেন। সেটা এখন থেকেই তৈরি করতে হবে। ভোটের ভাগ্য সন্ত্রাসীদের হাতে দেওয়া যাবে না। সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে তাদের আটক করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
কে এম নুরুল হুদা আরও বলেন, ‘২০১৪ সালের সহিংস অবস্থার কথা মাথায় রেখে নিরাপত্তার ছক তৈরি করতে হবে। বিনা কারণে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। কারও বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা যাবে না। সংঘবদ্ধভাবে প্রজাতন্ত্রের সব বিভাগ নির্বাচনের দায়িত্বে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সংবিধান ও আরপিওর বলে এখন সব দায়িত্ব আপনাদের কাছে। নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু, স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতাদের, দেশের নাগরিকদের, তাদেরও সম্পৃক্ত থাকার অনুরোধ করি। সবাইকে নিয়েই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছি। এরই মধ্যে প্রস্তুতির ৯৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু ব্যালট পেপার ছাপা হবে।’
বিএ-০৭/১৩-১২ (ন্যাশনাল ডেস্ক, তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)