কেউ চিরদিন ক্ষমতায় থাকে না স্মরণ করে দিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের উদ্দেশে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘কেউই চিরস্থায়ী নয়, আমি তোমাদের (পুলিশের) একাডেমিতে বক্তৃতায় বলেছি, এখনও বলছি কেউ বেআইনি আদেশ মানবে না’।
তিনি এ সময় বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে অভিযোগ তুলে বলেন, ‘যেসব পুলিশ গ্রেফতার করছে, তারা কেন এসব করছে? এ দেশে কোনো সংবিধান আছে? দেশে কোনো সংবিধান আছে বলে তো মনে হয় না। আসলে তারা বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত সংবিধানকে উপহাসের বস্তু বানিয়েছে’।
শুক্রবার বিকালে পুরানা পল্টনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন এসব কথা বলেন।
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পথে হামলার শিকার হওয়া এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই শীর্ষ নেতা। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এলাকায় হামলার শিকার হওয়ার বিষয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘এটা একটি সভ্য দেশ। যারা দেশ শাসন করছে, তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। আজ যারা হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নাও’।
এর আগে সকালে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ফেরার সময় ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলা হয় বলে গণফোরামের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
তাদের দাবি, হামলায় ড. কামাল হোসেনের গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও বহরের পেছনে থাকা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা আ স ম আবদুর রব, অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, ঢাকা-১৪ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী সিদ্দিক সাজুর গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১০-১২ জন আহত হন। সংবাদ সম্মেলনে আহতরাও উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের নিশ্চুপ ভূমিকা ও ধরপাকড় নিয়ে ড. কামাল বলেন, ‘সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষর জাতির জনকের। তোমরা বঙ্গবন্ধুর আদেশ অমান্য করছো? তোমরা ৫০-৫৫ বছর চাকরি করবে, বুঝে নিও, সংবিধান ভঙ্গ করার কাজ করো না। কার আদেশে এমন কাজ করছো তা আমাকে জানাও’।
পুলিশ-প্রশাসনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জেনে রাখো, চিরদিন কেউ ক্ষমতায় থাকে না। আর কোনো সরকারও আইনের ঊর্ধ্বে না। এই সরকার আর ১৬ দিন ক্ষমতায় আছে। সুতরাং বেআইনি আদেশ মানবে না’।
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে হামলা ঘটনা ‘কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না’ উল্লেখ করে অবিলম্বে তদন্ত দাবি করে ড. কামাল হোসেন পুলিশ বাহিনীকে সংবিধানের বাইরে কোনো ‘অন্যায় আদেশ’ না মানারও পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের দিনে সেখানে এই ধরনের ঘটনা আমাদের প্রতি কী হয়েছে সেটা আমরা চিন্তা করি না। শহীদদের প্রতি তারা অবমাননা করেছে। এটা মেনে নেয়া যায় না, এটা সারা দেশের কোটি কোটি মানুষ মেনে নিতে পারে না।’
আহত সাংবাদিকদের দেখিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘তাদের মেডিকেল সার্টিফিকেট আছে। রব সাহেবের (আহত) আঙুলটা দেখছেন। আইজি সাহেব আমি কথা দিচ্ছি- সব রকমের সাহায্য আমরা করব। আইনানুগ সাহায্য, তদন্ত করার সাহায্য করব। আপনার পুলিশের মধ্যে যাদের বিশ্বস্ত মনে করে তাদেরকে ডেকে একটু দায়িত্ব দিন, আমাদের সঙ্গে দিন।’
ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওখানে শহীদরা আছেন সেখানে আমরা গেছি শ্রদ্ধা জানাতে। এটাতে যাদের গায়ে লাগে ওরা কারা? ভাড়াটিয়া। পয়সা নিয়ে এসব তারা করেছে। এটা কোনো নীতির কাজ হতে পারে না। এই কাজ কোনো সুস্থ দেশপ্রেমিক মানুষের কাজ হতে পারে না। এ ঘটনায় শহীদদের আত্মা অবশ্যই কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের একটা জায়গা যেখানে মানুষ আসে শ্রদ্ধা জানাতে ১৪ ডিসেম্বর। এটা কী ভুলে গেছে তারা (সরকার), না তারা জানেই না। যেসব ছোকড়ারা ওখানে এসব কাজ করেছে। আমি দেখেছি ছোকড়ারা এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে, ইটপাটকেল মারছে, আহত করেছেন, গাড়ি ভাঙার চেষ্টা করেছে। এরা ছোকড়া, টোকাই।’
কারা এদের ভাড়া করেছে’ তাও জানতে চান ড. কামাল হোসেন। নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরুর পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, ‘যেসব পুলিশ কার আদেশে যারা (প্রার্থীরা) আইনানুগভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, কাজ করছেন তাদেরকে কেন এসে তারা (পুলিশ) চ্যালেঞ্জ করে, বাধা দেয়, কেন গ্রেফতার করে। এই অ্যারেস্ট অ্যারেস্ট অ্যারেস্ট। আমি প্রত্যেকটা অ্যারেস্টের তথ্য চাই।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘দেশে এখনো সংবিধান আছে। যে সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর এক নম্বর। উনি লিখে দিয়ে গেছে এ দেশের মানুষ আইনের আশ্রয় পাবে। পুলিশ আজকে যেটা করেছে এটা বঙ্গবন্ধুর কথাকে অমান্য করেছে। বঙ্গবন্ধু যেটাকে বলেছে হবে- তোমরা সেটাকে ডিফাই করেছো। তোমরা বঙ্গবন্ধুর কথাকে অমান্য করবে, এই বিজয়ের মাসে অমান্য করবে।’
যারা বেআইনি আদেশ দিচ্ছে তাদের দেশের মানুষ চিহ্নিত করে আগামীতে বিচার হবে বলেও জানান ড. কামাল হোসেন।
দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সরকারকে বলব, বেআইনি আদেশ দেয়া বন্ধ করুন, আপনারা আইন মেনে চলুন। সরকার আইনের ঊর্ধ্বে না। জেনে রাখো এই দেশে কোনো সরকার আইনের ঊর্ধ্বে না।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘এত লক্ষ শহীদ হয়েছেন, বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছেন। তারা শহীদ হয়েছিল যাতে আমরা মাথা উঁচু করে অধিকার নিয়ে বাঁচব। এই স্বাধীন দেশে ৪৭ বছর পরে যা দেখতে হচ্ছে- লজ্জা পাওয়া উচিত যারা দেশশাসন করছেন। লজ্জা পাও লজ্জা পাও, লজ্জা পাও। লজ্জা পেয়ে মুখটা দেখাও না। মুখটা একটু ঢেকে এদিক-ওদিকে থেকে ১০-১৫ দিন কাটিয়ে দাও। তোমাদের মুখ দেখব না, যারা এসব অন্যায় কাজ করছে। অবিলম্বে তা বন্ধ করো।’
গণমাধ্যমকে দেশের স্বার্থে জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ রেখে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার বিশ্বাস দেশের মানুয়ের প্রতি একশত ভাগ আস্থা আছে তারা সঠিক বিচার করবে, তারা সংবিধানকে সম্মুন্নত রাখবে, তারা আইনের শাসনকে দেশে ফিরিয়ে আনবে। আর যারা এসব অন্যায়-অনিয়ম-অসাংবিধানিক কাজ করছে তাদের থেকে আমাদেরকে মুক্ত করবে।’
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় থানায় মামলা করতে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে আমাদের নেতারা বলেছেন, থানার সামনে ওরা পাহারা দিয়ে রেখেছে। আপনাকে মেরে ফেলতে পারে।
তিনি বলেন, এই যদি হয় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, তাহলে কিসের নির্বাচন?’
রব বলেন, ‘শুক্রবার সকালে তারা আমাদের ওপর বর্বর হামলা করে। ইটপাটকেল, হকিস্টিক দিয়ে হামলা করে। এটি পরিকল্পিত হামলা। তারা চায় আমরা যেন নির্বাচন করতে না পারি। আমরা জনগণকে এখন প্রতিরোধের নির্দেশ দিচ্ছি না। আমরা ৩০ তারিখে ব্যালটের লড়াই করতে চাই। নির্বাচন থাকব। মরব, সরব না’।
তিনি বলেন, ‘আমরা মরব, কিন্তু সরব না। আমরা ৩০ তারিখে ব্যালটের লড়াই করতে চাই। এই স্বৈরাচারকে সরিয়ে দিতে চাই’।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আজকে বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে যাব সেখানে আক্রমণ করা হবে এটা অবিশ্বাস্য। এই অবিশ্বাস্য কাজগুলো সরকার ও তার দলের লোকজন কেন করছে এটা সকলের বোধগম্য। কারণ তারা হারতে চায় না। এত খুন-গুম, এত দুর্নীতি-লুটপাট করেছে যে তারা ক্ষমতা ছাড়তে ভয় পায়। অথচ আমরা আশ্বস্ত করেছিলাম যে, আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো হয়ে আছে। কিছুই করেন না সিইসি। তিনি মিন মিন করে বলেন আমরা বিব্রত। আরে আপনারা স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। আপনাদের বিব্রত হওয়ার কথা নয়, ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা, ব্যবস্থা নেয়ার কথা। আপনারা কী মসজিদের ইমাম নাকি। আমি ইসিকে বলব, আজকের ঘটনাসহ গত কয়েক দিনের ঘটনার বিচার ব্যবস্থা নিন। না নিতে পারলে ব্যর্থতার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে তাদের পদত্যাগ করা উচিত। এটাই তাদের জন্য সম্মানজনক হবে। মনে রাখতে হবে তারা প্রজাতন্ত্রের মানুষ, সরকারের না।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা ২৯ তারিখ পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে আছি। কিন্তু ৩০ তারিখে এই কামড় অন্যদিকে চলে যাবে।
শনিবার এখান থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত লংমার্চ করব। ১৬ তারিখ বিজয় দিবসে আমরা বিজয় র্যালি করব। আমরা বিজয় দিবসে দেখিয়ে দেব’।
এ সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনের ওপর হামলা করার মতো কোনো মানুষ এদেশে আছে বলে আমার জানা ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার জন্য আজকে এ ঘটনা ঘটাল তারা। আমার কথা হলো, তোমরা এমন কী করেছো যে ক্ষমতা হারানোর ভয় পাচ্ছো?’
সংবাদ সম্মেলনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির আবদুল আউয়াল মিন্টু, জেএসডির আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, জগলুল হায়দার আফ্রিক, আওম শফিকউল্লাহ প্রমুখ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিএ-১৪/১৪-১২ (ন্যাশনাল ডেস্ক, তথ্যসূত্র: যুগান্তর)