কেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল ৬০ সরকারি কর্মকর্তার

ভুল ব্যাখ্যা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ (প্রত্যয়নপত্র) নেওয়ায় ৬০ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও এ-সংক্রান্ত গেজেট বাতিল করা হয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশের ভিত্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার এসব সনদ বাতিল করা হয়। এখন এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

তবে চাকরির মেয়াদ বাড়াতে বা অন্যান্য সুযোগ নিতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্তত ছয় সচিব। ২০১৪ সালে তাঁদের সনদ বাতিল করা হলেও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বৃহস্পতিবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৬১ তম সভায় ৬০ জনের সনদ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে। এ সরকারের আমলে এটি জামুকার প্রথম সভা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে এ সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নতুন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১০ শতাংশের কম মুক্তিযোদ্ধার নাম যেসব উপজেলা থেকে এসেছে, তা আর যাচাই না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মোজাম্মেল হক বলেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে এসব গেজেট বাতিল করা হয়েছে। তবে শুধু সনদ বাতিল বা ফৌজদারি মামলা করা নয়, কেউ সনদ ব্যবহার করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকলে তা-ও ফিরিয়ে নেওয়া হবে। ভাতা নিতে থাকলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এভাবে আনুষ্ঠানিক সভা করে এত বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার সনদ আগে কখনো বাতিল করা হয়নি বলে জানান তিনি।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা যায়, গেজেট বাতিল হওয়া ৬০ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন সংস্থার মহাপরিচালক, কর পরিদর্শক, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সহকারী, পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যাংকার, শুল্ক কর্মকর্তা, শিক্ষক। আছেন পেশকার, অফিস সহকারী, কেরানি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তাঁদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এখনো চাকরি করছেন। কেউ চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে এ সুবিধা নিয়ে ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন। কেউ কেউ এখনো ভাতা পাচ্ছেন।

মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখাতে পারলেই এক বছর বেশি চাকরি করা যায়। এই সুযোগ কাজে লাগাতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের হিড়িক পড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে। আর এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পর। তবে এক বছর বেশি চাকরির সুযোগ ছাড়াও নিজের সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা-সুবিধাও রয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা মাসিক সম্মানীও পেয়ে থাকেন।

৬০ সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাবেক মহাপরিচালক সহিদুর রহমান ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে’ বাড়তি চাকরির মেয়াদ শেষ করে অবসরে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, তাঁর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পক্ষে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লাল মুক্তিবার্তায় তাঁর নাম ছিল না। তবু ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি চাকরি করে অবসরে যান তিনি।

জানতে চাইলে সহিদুর রহমান বৃহস্পতিবার বলেন, ‘উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে আমার সবকিছু ঠিক আছে। এ জন্য আমি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছি। আমার গেজেট বাতিল করা হলে আমি এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেব।’

গেজেট বাতিল হওয়া তালিকায় আছেন আয়কর কর্মকর্তা আ জা মু জিয়াউল হক। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়ায়। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এক বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে চাকরি করছেন। এ বছরের ডিসেম্বরে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হবে।

জিয়াউল হক বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আমার শুনানি করেছেন। আমার বয়স তখন কম ছিল।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স কত ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর জন্ম ১৯৫৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। সে সময় বয়স কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে তাঁর দাবি।

ফরিদপুরের সদরপুরের আবদুল মালেক বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কর্মকর্তা। ওহাব সরদার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। দুজনেরই গেজেট বাতিল হয়েছে। মালেক মুক্তিযোদ্ধা নন বলে জানিয়েছেন তাঁর এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মনিরুল হক। অন্যদিকে ওহাব সরদারকে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব মাসুদ সিদ্দিকী সনদ নিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন নগরকান্দার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক। তিনি বলেন, ওহাবকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁরা সুপারিশ করেননি।

চট্টগ্রামের পটিয়ার সমর কান্তি বড়ুয়া নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে বলেন, এ বিষয়ে তাঁর কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। তিনি চট্টগ্রাম আদালতের পেশকার ছিলেন। তাঁর মতো সনদ বাতিল হয়েছে ময়মনসিংহের এ বি এম তমিজউদ্দিনের। তিনি বাংলাদেশ বেতারের সাবেক কর্মকর্তা। তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের এ টি এম কামরুজ্জামান কৃষি ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা ছিলেন।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেকেন্দার আলী জানিয়েছেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের দেলদার হোসেন পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন, এখন অবসরে। সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তাঁর কাছে সব তথ্য-প্রমাণ আছে। কেউ বললেই তো আর সনদ বাতিল হবে না।

বিএ-০৩/২২-০৩ (ন্যাশনাল ডেস্ক, তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)