ঢাকাসহ দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন ঘটছে অগ্নিকাণ্ড। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগুনের ভয়াবহতা আর্থিক ক্ষতিকেও ছাপিয়ে যায় মানবিক বিপর্যয়। এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আগুনের নেপথ্যের নানা কারণ। এর মধ্যে অন্যতম ও প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট।
গত বছর ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সারাদেশে। সবচেয়ে বেশি সাত হাজার ৮২৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ঢাকাসহ সারাদেশে দুই হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ দায়ী বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। আর শর্ট সার্কিটের অন্যতম কারণ বহুতল বাণিজ্যিক ভবন কিংবা আবাসিক ভবনে নকল ইলেকট্রিক ক্যাবলের (বৈদ্যুতিক তার) ব্যবহার।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকেই বিল্ডিং কোড মানার চেষ্টা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন বৈদ্যুতিক ক্যাবল ব্যবহারে রয়েছে অনীহা। যে কারণে শর্ট সার্কিট থেকে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটছে। পুড়ে যাচ্ছে বিলাসবহুল ভবন, বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে আসলের চেয়ে নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবলের ছড়াছড়ি বেশি। দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানগুলোর তাগিদ সত্ত্বেও নকল ক্যাবল উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুতল বাণিজ্যিক ভবন কিংবা আবাসিক ভবনে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে গুণগত মানের ইলেকট্রিক ক্যাবল ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা- তা দেখার কেউ নেই। আবার আগুনের জন্য কেবল শর্ট সার্কিটই দায়ী নয়, সার্কিট ব্রেকারও দায়ী।
ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১৯ হাজার ৬৪২টি আগুনের ঘটনা অনুসন্ধানে এর নেপথ্যের ২০টি কারণ চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে চুলার আগুন থেকে তিন হাজার ৪৪৯টি, সিগারেটের টুকরা থেকে তিন হাজার ১০৮টি, খোলা বাতি ব্যবহারে ৬২৫টি, উত্তপ্ত ছাই/জ্বালানি থেকে ৬৬৭টি এবং অজ্ঞাত কারণে এক হাজার ৪১১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে সবচেয়ে বেশি সাত হাজার ৮২৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে।
এসব ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এক হাজার ৮৬২ কোটি নয় লাখ সাত হাজার ৪৮ টাকার মালামাল উদ্ধার করতে পারলেও ক্ষতি হয়ে যায় ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৫ টাকার জিনিসপত্র। এছাড়া বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
চলতি বছর শর্ট সার্কিট থেকে সৃষ্ট আগুনের মধ্যে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বনানীর এফআর টাওয়ার, ডিএনসিসি মার্কেট ও খিলগাঁও কাঁচাবাজারের ঘটনা জনমনে বেশ নাড়া দেয়। সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। যদিও সেখানে আগুনের সূত্রপাত ছিল ভিন্ন। কেমিক্যাল থেকে সৃষ্ট ওই আগুনে নিহত হন ৭১ জন। এছাড়া বহু লোক আহত হন।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, এক শিক্ষকের কক্ষে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।
গত ৪ এপ্রিল খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে কামারপট্টি বাজারের আগুন শর্ট সার্কিট থেকে লাগে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। এ আগুনে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর আগে ৩০ মার্চ ভোরে রাজধানীর গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগে। মার্কেটের কাঁচাবাজারের পূর্ব পাশে শর্ট সার্কিট থেকে লাগা এ আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট কাজ করে।
গত ২৮ মার্চ বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে ২৬ জন নিহত ও ৭৩ জন আহত হন। এফআর টাওয়ারের অষ্টম তলায় শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মোহাম্মদ এনামুর রহমান।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘দেশে এক নম্বর জিনিস পাওয়াই কঠিন। ৭০-৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট থেকে। বাজারে ভেজাল বৈদ্যুতিক ক্যাবল সহজলভ্য। সার্কিট ব্রেকার পর্যন্ত আপনি নকল ও মানহীন পাবেন।
‘আবার ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা-ডিজাইনের পাশাপাশি ইলেকট্রিক ডিজাইনটাও নিয়ম মেনে করা উচিত। যেটা অনেকেই করতে চান না। এগুলো মানা হয় না বলেই বহুতল ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী তদন্তে জানা যায়, শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাতের তথ্য।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, ‘মানহীন বৈদ্যুতিক তার ব্যবহারে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে। ভোল্টেজের তারতম্য ঘটলেই মানহীন বৈদ্যুতিক তার বহুতল ভবনে অগ্নিঝুঁকি বাড়ায়। তবে শর্ট সার্কিটের ক্ষেত্রে শুধু মানহীন তারই দায়ী নয়, এজন্য সার্কিট ব্রেকার বেশি দায়ী।
‘দুঃখজনক হলেও মানহীন সার্কিট ব্রেকারও বাজারে আছে। এসব দেখার বা নিয়ন্ত্রণের মতো দৃশ্যমান অগ্রগতি কখনও দেখা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা, ডিজাইনের পাশাপাশি ইলেকট্রিক ডিজাইনও করতে হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের কাছে আর আগের মতো কেউ আসে না।
বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক ডিজাইনটা কেমন হবে তা অথরাইজড কারও কাছ থেকে কাজ না করিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে করানো হয়।’
বিএ-১২/৩০-০৪ (ন্যাশনাল ডেস্ক)