সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ২৮ আগস্ট

ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ঋণ জালিয়াতি ও চার কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এসকে সিনহা) ১১ জনের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ২৮ আগস্ট ধার্য করেছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার মামলাটির এজাহার আদালতে পৌঁছলে ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এজাহার গ্রহণ করে দুদকের পরিচালক ও মামলার বাদী সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।

এস কে সিনহা ছাড়া মামলার বাকি আসামিরা হলেন- ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়।

এর আগে বুধবার দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ৪ কোটি টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে এসকে সিনহার ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তরের অভিযোগ করা হয় মামলায়।

দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ও (৩) ধারায় মামলাটি দায়ের হয়েছে। দুদকের ঢাকা জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে মামলা রেকর্ড করা হয়।

এসকে সিনহা বর্তমানে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় মেয়ের কাছে বসবাস করছেন। মামলার আসামি হিসেবে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে কিনা এ বিষয়ে জানতে চান সাংবাদিকরা। এর জবাবে দুদক সচিব মো. দিলোয়ার বখত বুধবার বিকালে বলেন, বিদেশে অবস্থানরত অন্যান্য আসামিদের ক্ষেত্রে যা হয় তার (এসকে সিনহা) ক্ষেত্রেও তাই করা হবে।

মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, ব্যাংক থেকে ভুয়া ঋণের নামে ৪ কোটি টাকা বের করে পরে ওই অপরাধলব্ধ আয় ব্যক্তিগত হিসাব থেকে অস্বাভাবিকভাবে নগদে, চেক বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্য হিসাবে স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ। আসামিরা ওই অর্থ নিজেদের ভোগদখল ও তার অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান গোপনের মাধ্যমে পাচার বা পাচারের প্রচেষ্টায় সংঘবদ্ধভাবে সম্পৃক্ত হন।

গত বছর অক্টোবরে ফারমার্স ব্যাংকের দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতির ‘প্রমাণ’ পাওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। কথিত ব্যবসায়ী শাহজাহান ও নিরঞ্জন ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে চার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিলেন।

সেই টাকা রনজিৎ চন্দ্র সাহার হাত ঘুরে বিচারপতি সিনহার বাড়ি বিক্রির টাকা হিসেবে খাতা-কলমে দেখিয়ে তার ব্যাংক হিসাবে ঢুকেছে বলে অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধানে নামে দুদক।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

দুদকের মামলায় অভিযোগ আনা হয়- ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি এসকে সিনহাসহ অন্য কয়েকজনের বিষয়ে অনুষন্ধান শুরু হয়। অভিযোগ অনুসন্ধানকালে রেকর্ডপত্র, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জনৈক মো. শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংক গুলশান শাখায় পৃথক ২টি চলতি হিসাব খোলেন। (যার নম্বর ০১১১১০০১৫৬৩৪১ ও ০১১১১০০১৫৬৩৪৯)।

এর পরের দিনই ফারমার্স ব্যাংক গুলশান শাখায় মো. শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা পৃথকভাবে ২ কোটি টাকা করে ৪ কোটি টাকার ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য ঋণ আবেদন করেন। ওই ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং ঋণ আবেদনপত্রে তারা দু’জনই তাদের ঠিকানা হিসেবে বাড়ি নং-৫১, রোড নং-১২, সেক্টর-১০, উত্তরা আবাসিক এলাকা উল্লেখ করেন। অনুসন্ধানকালে জানা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে ওই বাড়িটি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যক্তিগত বাড়ি।

মামলায় উল্লেখ করা হয়, ঋণ আবেদনের বিপরীতে জামানত হিসেবে রনজিৎ চন্দ্র সাহার স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারে ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করেন। তারা দু’জন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ কুমার সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ।

মো. শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহার ওই ঋণসংক্রান্ত আবেদন দুটি কোনো রকম যাচাই-বাছাই, রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ ও ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতি না মেনে শুধু গ্রাহকের আবেদনের ওপর ভিত্তি করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে তাতে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বাক্ষর করেন।

ব্যাংক শাখার ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শাখার অপারেশন ম্যানেজার লুৎফল হক ও ক্রেডিট ইনচার্জ শাফিউদ্দিন আসকারী এ প্রক্রিয়াটি তড়িঘড়ি সম্পাদন করেন। পরে ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ হাতে হাতে ঋণ প্রস্তাব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান।

প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায়ও ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি যাচাই-বাছাই ছাড়া তাতে অফিস নোট তৈরি করে স্বাক্ষর দেন। তিনি তা ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান।

গাজী সালাহউদ্দিনও কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাতে স্বাক্ষর করে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীমের কাছে নিয়ে যান। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ পলিসিসংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী ঋণ দুটির প্রস্তাব অনুমোদন করার ক্ষমতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ছিল না।

অথচ তিনি এ সংক্রান্ত ঋণ প্রস্তাব দুটি অনুমোদন করেন। এছাড়াও ফারমার্স ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে ঋণ অনুমোদন জন্য নথি উপস্থাপিত করা হলে নথির নোটাংশে হাতে লেখা হয়, ‘দ্যোস ফর হি হ্যাজ বিন রিসিভিং সাচ সাপোর্ট ফরম মি. এসকে সিনহা, চিফ জাস্টিস হাউস, কাকরাইল ঢাকা, অ্যান্ড টু কন্টিনিউ স্কয়ার আপ বিজনেস মি. এসকে সিনহা’।

মামলায় আরও বলা হয়, পরবর্তীতে ওই নোট পরিবর্তন করে নতুন নোট তৈরির পর তাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ এমডি স্বাক্ষর করেন। ওই প্রক্রিয়ায় ঋণ মঞ্জুর হওয়ার পরের দিন ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর মো. শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহার আবেদনের ভিত্তিতে ঋণ হিসাবে অনুমোদিত ৪ কোটি টাকার পৃথক দুটি পে-অর্ডার সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ইস্যু করা হয়।

পরে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামীয় সোনালী ব্যাংক সুপ্রিমকোর্ট শাখার হিসাবে (হিসাব নং-৪৪৩৫৪৩৪০০৪৪৭৫) ৯ নভেম্বর ওই ৪ কোটি টাকা জমা হয়। বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে তিনি (এসকে সিনহা) বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে ওই হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করেন।

এর মধ্যে শাহজালাল ব্যাংক উত্তরা শাখায় তার এক ভাইয়ের নামে থাকা হিসাবে (হিসাব নং- ৪০০৮১২১০০০৪৯০৪২) দুটি চেকের মাধ্যমে ২৮ নভেম্বর যথাক্রমে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬ হাজার ও ৭৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়।

পরে ওই হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ/চেকের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। মামলায় উল্লেখ করা হয়, আসামি রনজিৎ চন্দ্র সাহা ব্যাংকে উপস্থিত থেকে ঋণ আবেদন দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির নাম করে প্রভাব বিস্তার করেন।

এছাড়া ঋণ আবেদনকারী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা রনজিৎ চন্দ্র সাহার ভাতিজা এবং মো. শাহজাহান মি. রনজিৎ চন্দ্র সাহার ছোটবেলার বন্ধু। তারা দু’জনই অত্যন্ত গরিব দুস্থ। তারা কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি। তাদের কোনো ব্যবসা নেই।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার ঘনিষ্ঠ রনজিৎ চন্দ্র সাহার মাধ্যমে তাদের ভুল বুঝিয়ে ব্যাংকের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেয়ার ব্যবস্থা করেন।

অর্থাৎ আসামি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাপর আসামিদের সহায়তায় প্রভাব বিস্তার করে ফারমার্স ব্যাংক ঋণ সৃষ্টি করে নিজের ব্যক্তিগত হিসাবে ওই টাকা হস্তান্তর করেন। ঘটনাটি অনুসন্ধান করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ও সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান।

বিএ-০২/১১-০৭ (ন্যাশনাল ডেস্ক)