এত কষ্টের অর্জন যেন দুর্নীতিতে নষ্ট না হয়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যথাযথ পদক্ষেপ প্রহণের আহবান জানিয়ে বলেছেন, আপনারা দেখেবেন দুর্নীতির কারণে আমাদের অর্জনগুলো যেন নষ্ট হয়ে না যায়।

শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী তার তেজগাঁওস্থ কার্যালয়ে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে একথা বলেন। খবর বাসসের

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা (জেষ্ঠ্য সরকারী কর্মকর্তা) তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বন্ধে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন। যাতে করে আমাদের এত কষ্টের অর্জনগুলো দুর্নীতির কারণে নষ্ট না হয়ে যায়।’

প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমরা এত খেটে, সারাদিন এত কাজের পরে যদি দুর্নীতির কারণে সব অর্জন নষ্ট হয়ে যায় সেটা হবে খুব দু:খজনক। এটা কোনভাবেই সহ্য করা হবে না।’

তিনি এ বিষযে সকলকে দায়িত্বশীল হওয়ার পাশাপাশি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হওয়ারও আহবান জানান।

তিনি বলেন, ‘যে ঘুষ নেবে সেই কেবল অপরাধী নয়, যে ঘুষ দেবে সে ও অপরাধী। কাজেই দুর্নীতির কারণে আমাদের উন্নয়নটা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে সকলকে খেয়াল রাখতে হবে।’

বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) মূলত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা দলিল।

একইভাবে মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিবগণ সংযুক্ত দপ্তর/সংস্থাসমূহের সঙ্গে এবং দপ্তর/সংস্থাসমূহের প্রধানগণ মাঠ পর্যায়ের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের কৌশলগত উদ্দেশ্যসমূহ, এ সকল উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য গৃহীত কার্যক্রমসমূহ এবং এ কার্যক্রমের ফলাফল পরিমাপের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক ও লক্ষ্যমাত্রাসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট অর্থবছর সমাপ্ত হওয়ার পর ঐ বছরের চুক্তিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের প্রকৃত অর্জন মূল্যায়ন করা হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রথম বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বা এপিএ প্রবর্তন করা হয়। এবার ৬ষ্ঠ বছরের মত এ চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের যে মানুষগুলি তাদেরকে সকল নাগরিক সুবিধাটা আমরা দিতে চাই। যাতে করে তাদেরকে কাজ খোঁজার জন্য আর গ্রাম থেকে শহরে আসতে না হয়। নিজের গ্রামেই সব ধরনের আধুনিক সুযোগ সুবিধা তারা পেতে পারে।

তিনি বলেন, মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ বাড়ার ফলে এবং যেহেতু আমরা ঘোষণা দিয়েছি ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ তাই যত্রতত্র দালান কোঠা ও স্থাপনা তৈরি হওয়ায় কৃষিজমি কমে যাওয়ার একটা আশংকা দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে মাষ্টার প্লান থাকা এবং তা যথাযথভাবে কার্যকরের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা বোধ হয় আমাদের একটু দেখা উচিত যে, কিভাবে আমাদের কৃষি জমিগুলোকে আমরা রক্ষা করবো। পরিবেশ এবং প্রতিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ন যেন পরিকল্পিতভাবে করা যায়।’

শিল্পায়নের জন্য সারাদেশে একশ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যত্র তত্র যেখানে সেখানে ঘর-বাড়ি এবং কল কারখানা এভাবে যদি হতে থাকে তাহলে যেমন আমাদের আবাদি জমিও নষ্ট হবে তেমনি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য নাগরিক সুবিধা দেওয়াটাও একটু কঠিন হয়ে যাবে।’

তিনি এজন্য মানুষকে বোঝানোর এবং নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপনা নির্মান করলে তারা যে সুবিধাগুলো পাবেন সেগুলো সম্পর্কে তাদের অবহিতকরণের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতি আহবান জানান।

একইসঙ্গে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাধি নির্মূলে সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন এবং এই ধারা অব্যাহত রাখার, যাতে করে কোনভাবেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকারও আহবান জানান।

অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়,বিভাগ এবং দপ্তরের সিনিয়র সচিব এবং সচিববৃন্দ একযোগে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে একে একে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তা তুলে দেন।

বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি সম্পাদনের সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ অনুষ্ঠানে ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সম্মাননা পত্র এবং ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এরমধ্যে ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক কর্মসংস্থান চুক্তি সম্পাদনে সাফল্যের বিবেচনায় বিদ্যুৎ বিভাগ প্রথম, বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ দ্বিতীয় এবং জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ বিভাগ তৃতীয় স্থান অর্জন করায় অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সচিবদের হাতে প্রধানমন্ত্রী ক্রেষ্ট এবং সম্মাননা পত্র তুলে দেন।

শুদ্ধাচার চর্চা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং সরকারী কর্মচারিদের শুদ্ধাচার চর্চায় উৎসাহ প্রদানে সরকার প্রদত্ত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শুদ্ধাচার পুরস্কার লাভ করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল মালেক বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে তাঁর মন্ত্রণালয়ের সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরুপ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে সম্মাননা পত্র গ্রহণ করেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রলালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সুরক্ষা বিভাগ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সচিবগণও প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে এপিএ’র সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মাননা পত্র গ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, মন্ত্রী পরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম, মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড.আহমেদ কায়কাউস বক্তৃতা করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, বিভিন্ন সিনিয়র সচিব এবং সচিববৃন্দ, বিভিন্ন বিভাগ এবং দপ্তরের প্রধানগণ, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারী প্রদর্শিত হয়।

ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। সেইসঙ্গে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়কে আমরা ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি।

তিনি বলেন, এর মধ্যে বাংলাদেশে একটা ভিক্ষুকও থাকবে না। একটা মানুষও গৃহহারা থাকবে না। একটা মানুষও না খেয়ে কষ্ট পাবে না।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘অন্তত মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো আমরা পূরণ করব। তাদের জীবনের ন্যূনতম চাহিদা, সেটা যেনো আমরা পূরণ করতে পারি, সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সমস্ত পরিকল্পনা, সমস্ত কাজ করতে হবে।’

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কথাও বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, গ্রামের জনগণকে যেন শহরে ভিড় করতে না হয়। নিজের গ্রামেই তারা যেন সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার ফলেই দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষ অপনাদের কাজের সুফল পাচ্ছে।
তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের কাজের ফলেই আমাদের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে, মাথা পিছু আয় বেড়েছে। দেশ এগিয়ে যাওয়া এবং মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ার ফলেই আজ আমরা ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিতে পেরেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘ পরিকল্পনা ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা সবসময় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। আগামী ২১ এবং ৪১ সালকে সামনে রেখে আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে ৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত একটি দেশ।

চীনের প্রবৃদ্ধির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘চীনের থেকেও আমাদের প্রবৃদ্ধ বেশি। আমাদের প্রবৃদ্ধি ইতোমধ্যে ৮ দশমিক ১ ভাগে পৌঁছেছে। এ অর্থবছরের শেষ নাগাদ ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনই আমাদের লক্ষ্য। আর এটা আমরা করতে পারব বলেই বিশ্বাস করি।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের সাফল্য তুলে ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা প্রসংগে সরকারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকার আভাস দেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমেছে এবং আমাদের কাজে গতিশীলতা বেড়েছে, দক্ষতা বেড়েছে। সেই সাথে কাজের আগ্রহটও বেড়েছে।’

এ প্রসঙ্গে সরকার প্রধান বলেন, ‘এখন তো ডিজিটাল যুগ। তার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। কিভাবে কোন কাজটা করলে দেশটা আরও উন্নত হতে পারে বা দ্রুত আমরা কাজটি করে লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারব, সেটা আপনাদের চিন্তা করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির বাস্তবায়নে সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননাপ্রাপ্ত ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে অভিনন্দন জানান।

বিএ-০৮/১৩-০৭ (ন্যাশনাল ডেস্ক)