সংসদ নির্বাচনে বক্তৃতার নামে সিইসি, কমিশনার, সচিবদের পকেটে দুই কোটি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনারদের মতো সাংবিধানিক পদের পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা না দিয়ে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের সঙ্গে আছেন ইসির সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। আর এই অর্থের পরিমাণ একেবারে কম নয়, দুই কোটি টাকার বেশি।

বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও এরপরে উপজেলা নির্বাচনে প্রশিক্ষণ উপলক্ষে শুধু ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দিয়ে তাঁরা এই অর্থ নিয়েছেন। আর এর বাইরে ‘কোর্স উপদেষ্টা’ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব (বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব) একাই নিয়েছেন ৪৭ লাখ টাকা। তিনি ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবেও টাকা নিয়েছেন। তবে তা কত জানা যায়নি।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশন ৬১ কোটি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। আর উপজেলা নির্বাচনে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

ইসির তথ্য অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে যাঁরা টাকা নিয়েছেন তাঁরা হলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা; চার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ও কবিতা খানম; সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ; অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান এবং দুই যুগ্ম সচিব আবুল কাশেম ও কামরুল হাসান। উপজেলা নির্বাচনে ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেব এর সঙ্গে আরও চারজন যুগ্মসচিব যুক্ত হয়েছেন। এদিকে উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে একটি প্রশিক্ষণ থেকে ‘কোর্স পরিচালক’ হিসেবে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুক নিয়েছেন ১৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ ‘বিশেষ বক্তা’, ‘কোর্স উপদেষ্টা’ ও ‘কোর্স পরিচালক’ হিসেবে তাঁদের পকেটে গেছে দুই কোটি টাকার বেশি।

এভাবে অর্থ নেওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সিইসি ও চার কমিশনারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সাবেক ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি।

বিগত সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশন ‘বিশেষ বক্তা’র একটি প্যানেল গঠন করা হয়। এতে সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনের উচ্চপদস্থ ১৩ কর্মকর্তা। আর ‘কোর্স উপদেষ্টা’ নামে আরেকটি পদ সৃষ্টি করে তাতে পদায়ন করা হয় সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে।

ইসি সচিবালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় নয়জন ‘বিশেষ বক্তা’ ১৮ দিনে (৭ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮) জেলা ও উপজেলার ৫২০ জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছেন। প্রতিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চারজন ‘বিশেষ বক্তা’র উপস্থিত থাকার কথা। ফলে সাধারণ পাটিগণিতের হিসাবে প্রত্যেক ‘বিশেষ বক্তা’কে দিনে কমপক্ষে ১৪টি স্থানে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। বাস্তবে যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ থেকে বোঝা যায়, বক্তৃতাস্থলে উপস্থিত না থেকেই তাঁরা টাকা নিয়েছেন। এভাবে অর্থ নেওয়ার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় যাঁরা অর্থ নিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ সম্মানী ভাতা ফেরত পাঠাতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।

ইসির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের এভাবে অর্থ নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইসির ইতিহাসে এমন ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণ হয়নি। আমাদের সময়ে সিইসি, আমি ও অন্য কমিশনাররা দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণে বক্তৃতা দিয়েছি। কিন্তু কোনো ভাতা নিইনি। এমনকি সচিবও বক্তৃতা দিয়ে ভাতা নিতেন না। সে রকম রেওয়াজও ছিল। এবার যা ঘটেছে সেটা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এ জন্য অবশ্যই জড়িতদের দায় নিতে হবে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে প্রশিক্ষণের জন্য অতীতে ‘বিশেষ বক্তা’ বা ‘কোর্স উপদেষ্টা’ বলে কিছু ছিল না। গত নির্বাচনের সময় এসব সৃষ্টি করা হয়েছে কেবল অবৈধভাবে টাকা নেওয়ার জন্য।

ইসির নথিতে আছে, সিইসিসহ এই কর্মকর্তারা ১৮ দিনে ৫২০টি স্থানে বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু প্রথম আলো ছাড়াও জনকণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ ও ডেইলি স্টার ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৭ থেকে ২৪ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে সিইসি দুবার ঢাকার বাইরে যান। ১৮ ডিসেম্বর সিইসি চট্টগ্রাম-রাঙামাটিতে এবং ২২ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে যান। সেখানে তিনি শীর্ষ বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। চট্টগ্রাম সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ও সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ। এর বাইরে কমিশনার রফিকুল ইসলাম ১৫ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে এবং ২১ ডিসেম্বর রাজশাহীতে নারীদের ভোটাধিকার বিষয়ক দুটি কর্মশালায় অংশ নেন। কবিতা খানম ২২ ডিসেম্বর যশোরে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন। প্রশিক্ষণ প্রতি তাঁদের প্রত্যেকের সম্মানী ছিল পাঁচ হাজার টাকা।

তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মহাহিসাব নিরীক্ষক এম হাফিজ উদ্দীন বলেন, এখানে প্রশিক্ষণের নামে লুটপাট হয়েছে। ‘বিশেষ বক্তা’র নামে পুরো কমিশন ও সচিব যে টাকা নিয়েছেন তার পুরোটাই বেআইনি। কারণ, প্রশিক্ষণের অর্থ হলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে খাতায় সই করতে হবে। টাকা নেওয়ার সময়ও সই করতে হবে। তাঁরা সেটা করেছিলেন কি না, তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে।

ইসির হিসাব বলছে, সংসদ নির্বাচনে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে বরাদ্দ ছিল ৪৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এই অর্থ থেকে ১ কোটি ৪ লাখ টাকা ভাগ করে নিয়েছেন নয় জন ‘বিশেষ বক্তা’। এই হিসাবে প্রতিজনের ভাগে পড়ে ১১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ৫২০টি প্রশিক্ষণের প্রতিটিতে ৪ জন করে ‘বিশেষ বক্তা’ দেখানো হয়েছে। ইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, সিইসি, চার নির্বাচন কমিশনার ও চার কর্মকর্তা এভাবে দেশজুড়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালে সংসদ নির্বাচনের মতো বিশাল আয়োজনের বাকি কাজ বন্ধ রাখতে হতো।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচন করা নির্বাচনের কমিশনের কাজ। কোথাও গিয়ে বক্তৃতা দিলেও সেটা কাজের অংশ। এ থেকে ভাতা নিতে হবে কেন? পুরো ব্যাপারটাই অন্যায়, অনৈতিক।

বিএ-১৫/০৯-০৮ (ন্যাশনাল ডেস্ক, তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)