বুয়েটের তিন হলে ৭ টর্চার সেল, নিয়মিতই চলে নির্যাতন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তিন হলে ছাত্রলীগের অন্তত ৭ টি টর্চার সেল রয়েছে। এসব টর্চার সেলে নিয়মিতই চলে ছাত্র নির্যাতন!

এমনই একটি টর্চার সেলে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নির্যাতন চালানোর বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে।

ফাহাদের আগেও অনেক শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন হলে। তুচ্ছ ঘটনায় এমনকি সালাম না দেওয়ার অজুহাত তুলেও তাদের পেটানো হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুয়েটের হলে হলে নিয়মিতই নির্যাতন চলে। আর এ ‘কাজে’ ব্যবহারের জন্য স্টাম্প ও লাঠি প্রস্তুত রাখে ছাত্রলীগ।

বুয়েটের আটটি হলের মধ্যে তিনটি হলের সাতটি টর্চার সেল সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই পরিচিত। এসব কক্ষে শিক্ষার্থীদের ডাক পড়লে ধরেই নেওয়া হয় তিনি মার খেতে যাচ্ছেন।

অন্য শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করলে তাঁর ওপরও চলে নির্যাতন। ফলে বুয়েটে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ভয়ের ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।

কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষটি টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত। এই হলে থাকেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।

আহসানউল্লাহ হলের ১২৩, ৩২০, ৩২১ ও ৩২২ নম্বর কক্ষে প্রায়ই বিভিন্ন অভিযোগে শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে মারধর করা হয়। এই হলেই থাকেন ছাত্রলীগ সভাপতি। আর কাজী নজরুল ইসলাম হলের ২০৫ ও ৩১২ নম্বর কক্ষও মারধরের জন্য ব্যবহার করা হয়।

জানা যায়, গত এক মাসেই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ অন্তত আট থেকে ১০টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটায়, যার বেশির ভাগই শিবির সন্দেহে পিটুনি।

যদি কেউ ফেসবুকে ধর্মীয় কোনো পোস্ট দেন, ধর্মীয় কোনো পেজে লাইক দেন, সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন তাহলেই তাকে শিবির বলে সন্দেহ করা হয়। রাজনৈতিক কক্ষে নিয়ে তাকে মারধর করা হয়।

এ ছাড়া নেতাদের দেখলে সালাম না দেওয়া, ডাইনিং ও টিভি রুমে সিট ছেড়ে না দেওয়াসহ অসংখ্য ছোট ছোট কারণেও বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেন।

লাঠি দিয়ে পেটানো, হাত-পা ভেঙে দেওয়া, হল থেকে বের করে দেওয়া বুয়েট ছাত্রলীগের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।

গত ৩ অক্টোবর রাতে শেরেবাংলা হলের ২০২ কক্ষে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এহতেশামকে মারধর করে।

মারধরে অংশ নেন আবরার হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল, সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ। মারধর শেষে এহতেশামকে এক কাপড়ে হল থেকে বের হয়ে যেতে বলে।

এহতেশামকে তার ব্যবহার্য কোনো জিনিসপত্রও নিতে দেওয়া হয়নি। বের করে দেওয়ার এক দিন পর তাঁর জিনিসপত্র নিতে গেলে তা পাওয়া যায়নি।

গত ২৭ জুন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অভিজিৎ করের। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কর গত ৩০ জুন নিজের ফেসবুক পোস্টে তার ওপর নির্যাতনের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করেন।

ফেসবুকে তার বর্ণনা অনুযায়ী, ২৭ জুন রাত সাড়ে ১২টার দিকে আহসানউল্লাহ হলের ২০৫ নম্বর রুমে তাকেসহ প্রথম বর্ষের বেশ কয়েকজনকে ডেকে আনা হয়।

তারপর এক এক করে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তাদের মারধর করা হয়। এর মধ্যে দাড়ি রাখার জন্য একজনকে কষে থাপ্পড় মারা হয়। জ্যেষ্ঠ ছাত্রকে সালাম না দেওয়ার কারণে

আরেকজনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এরপর অভিজিৎ করকে চুল লম্বা রাখার কারণে থাপ্পড় দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। তাকে আরো মারধরও করা হয়।

গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর রশিদ হলে ৩০৮ নম্বর কক্ষে ১৫তম ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের মেহেদী হাসান ও নেভাল আর্কিটেকচার বিভাগের নীলাদ্রি নিলয় দাস শিবির সন্দেহে মেকানিক্যাল বিভাগের সাদ আল রাজিকে মারধর করেন।

গত বছর রশিদ হল ফেস্টের ফি না দেওয়ার কারণে ১৪তম ব্যাচের সিভিল বিভাগের মিনহাজ, অয়ন, সৌরভ; ১৫তম ব্যাচের সিভিল সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারি বিভাগের নাসিমকে বেদম প্রহার করা হয়। ওই হলের ৪০৫ নম্বর রুমে এই মারধরের ঘটনা ঘটে।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত অভিকে মিছিলে যেতে বলেন উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা। কিন্তু তার মিছিলে যেতে একটু দেরি হওয়ায় অমিত তাকে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে বেদম প্রহার করেন। এতে তাঁর হাত ভেঙে যায়। তবে তাকে বলতে বাধ্য করা হয়, সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙে গেছে।

গত বছর রশিদ হলের ১১ ব্যাচের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অনুপ, ১৩ ব্যাচের পানি সম্পদ বিভাগের সম্রাট, ১৪ ব্যাচের মিনহাজ শিবির সন্দেহে ও ১৩ ব্যাচের নগর পরিকল্পনা বিভাগের সেতুকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেন।

২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে শেরেবাংলা হলের গেস্টরুমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কর্মরত তিন সাংবাদিককে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এক শিক্ষার্থীকে আটকে নির্যাতনের ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তাঁদের আটকে রেখে মারধর করা হয়। মারধরে অংশ নেন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক নাফিউল আলম ফুজি, যুগ্ম সম্পাদক ইফতেখারুল হক ফাহাদ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এস এম মাহমুদ সেতু।

একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে গত রবিবার দিবাগত রাতে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শেরেবাংলা হলে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাসেলের নেতৃত্বেই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।

আর তাঁর সহযোগীরা হলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতাসিম ফুয়াদ, সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনীক সরকার এবং গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না, ছাত্রলীগের সদস্য মুন্তাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বি তানিমসহ আরো বেশ কিছু নেতাকর্মী এই নির্যাতনে অংশ নেন। তাঁরা নিয়মিতই এই হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনে অংশ নিতেন বলে জানা যায়।

পানিসম্পদ পুরকৌশল বিভাগের ১৬তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠকে বলেন, আবরার হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এ রকম ঘটনা বিভিন্ন হলে ঘটছে। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না গেলে তাঁকে শিবির বানিয়ে মারধর করা হয়। হলগুলোতে নির্দিষ্ট টর্চার সেল রয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী একটু উচ্চবাচ্য করলেই তাঁকে নির্যাতন করা হয়।

১৬তম ব্যাচের সিভিলের শিক্ষার্থী রাওয়াদ বলেন, ‘১০ বছরে বুয়েটের ইতিহাসকে নির্যাতনের ইতিহাস বানিয়ে ফেলেছে ওরা। আবরার হত্যার ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারাই ওই হলের সাম্প্রতিক সব নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত।

প্রশ্রয় পেতে পেতে তারা একজন শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলল। কোনো ঝামেলায় না জড়াতে নির্যাতন নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না। আমাদের বুয়েট এ রকম ছিল না। ছাত্রলীগ বুয়েটকে কলঙ্কিত করছে।’

১৭তম ব্যাচের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আয়াত আরেফিন বলেন, প্রতিনিয়তই মারধরের ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের নির্দেশনার বাইরে কোনো কথা বললেই নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়। পরে শিবির বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

বিএ-১৪/০৯-১০ (ন্যাশনাল ডেস্ক)