কোনো অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচনের ফলাফল বাতিলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে।
বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের আপত্তির মুখে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বিলটি পাস হয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য সংসদে দাবি করেছেন যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি।
যেসব সংশোধনী এলো
বর্তমান আরপিও অনুযায়ী, অনিয়ম বা বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ইসি যদি মনে করে নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে।
এখন এই ক্ষমতা সীমিত করে শুধু ভোটের দিন অনিয়মের কারণে নির্দিষ্ট সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ করতে পারার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে।
আরপিওর সংশোধনী অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করে ফেলার পর কোনো আসনের পুরো ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব ভোটকেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করা যাবে।
এরপর তদন্ত সাপেক্ষে ফলাফল বাতিল করে ওই সব কেন্দ্রে নতুন নির্বাচন দিতে পারবে ইসি।
সংশোধনীতে আরপিওর ৯১ ধারার (এ) উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ইলেকশন’ শব্দ দিয়ে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া বোঝায়। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়টা হলো ‘ইলেকশন’। আর ‘পোলিং’ হলো শুধু ভোটের দিন। এই সংশোধনী পাস হওয়ায় নির্বাচন কমিশন অনিয়মের কারণে শুধু ভোটের দিন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে।
কিন্তু ‘ইলেকশন’ শব্দটি থাকলে ভোটের আগেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারত। তাই এখানে তাদের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে। তবে আইনে ‘ইলেকশন’ শব্দটির সংজ্ঞাও পরিষ্কার নয়।
এ ছাড়া সংশোধিত আরপিওতে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যমকর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের কাজে কেউ বাধা দিলে তাকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধে সর্বনিম্ন ২ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এছাড়া মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ এবং টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সরকারি সেবার বিল পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আগে মনোনয়ন দেওয়ার ৭ দিন আগে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হতো।
সংসদ সদস্যদের আপত্তি
বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ‘আরপিরও মধ্যে কতগুলো ক্লজ লাগানো হলো যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে। আমরা জানি নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা করলে যেকোনো নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু এই অধিকার খর্ব করা হল।’
‘এখন তারা সেন্টারগুলো বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু পুরো নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। এটা হলে এই ইসি দিয়ে আমরা কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচনটা করাব,’ বলেন তিনি।
ফখরুল ইমাম আরও বলেন, ‘আগের দিন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের বিধানের মাধ্যমে আমরা ঋণখেলাপীকে নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এই আইনে যেটা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং এই কমিশন দিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না।’
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, ‘দেশে আইন হয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সরকারের স্বার্থে। নির্বাচনের আগে এমন আইন করা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন ব্যবস্থা এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে মানুষ এখন ভোট বিমুখ।’
মোকাব্বির খান আরও বলেন, ‘দেশের মানুষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার সবগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বলেছিলেন, “আমরা যদি ভোট চোর হই, তাহলে বিএনপি ভোট ডাকাত।” চরম সত্যটা স্বীকার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। জনগণ ভোট চোর বা ভোট ডাকাতদের খেলার দর্শক হিসাবে আর দেখতে চায় না।’
‘নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে প্রত্যেকটি দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন সর্বকালের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘ইচ্ছা থাকলে দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনেই সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব। ইসির মানসিকতার ওপর নির্ভর করে নির্বাচন। শত আইন করে দিলেও মেরুদণ্ডহীন লোকদের দিয়ে কিছু হবে না।’
পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘এই আইনে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এটি ঠিক হয়নি। আগে যেখানে পুরো ভোট বন্ধের সুযোগ ছিলো, সেটা বন্ধ করে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বাহাত্তারের আদেশ বহাল থাকলে ইসি শক্তিশালী হতো।’
তিনি বলেন, ‘এতদিন আইনে ইলেকশন শব্দ ছিল। ইলেকশন বলতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত বোঝায়। সেটা বাদ দিয়ে পোলিং যুক্ত করা হয়েছে। এর অর্থ শুধু ভোটের দিন। ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে, তারা শুধু ভোটের দিন ভোট বন্ধ করতে পারবে।’
বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘একটি আসনে ১০০-১৪০টি পোলিং সেন্টার থাকে। আগে বলা ছিল ৩-৪টি পোলিং সেন্টারে কোনো সহিংসতা বা অনিয়ম হলে সবগুলো পোলিং সেন্টারের ইলেকশন বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু সেটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। সেটা জনগণের ভোটাধিকারেরও পরিপন্থী। কারণ বাকিগুলোতে তো কোনো সহিংসতা বা অনিয়ম হয়নি। এজন্য বলা হয়েছে যেখানে সহিংসতা বা অনিয়ম হয়েছে সেগুলো বন্ধ হবে।’
‘কেন উনারা বলছেন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। উনাদের এই কথাটা অমূলক,’ যোগ করেন মন্ত্রী।
আনিসুল হক বলেন, ‘যে সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেটা ১৯৭২ এর আরপিওতে ছিল না। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এই সংশোধনীর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু মন্ত্রীসভায় যখন এটা যায় তখন “গণতন্ত্র পরিপন্থী” জায়গাটি সংশোধন করা হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী দাবি করে বলেন, ‘ঋণখেলাপী থেকে ব্যাংকে যেন টাকা ফেরত আসে এবং অর্থঋণ আদালতের উদ্দেশ্য যেন প্রতিপালিত হয় তার জন্য এটা করা হয়েছে। তাদের উৎসাহিত করার জন্য এটা করা হয়েছে।’
সংবিধান অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন বলছে, ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারি মাসের শুরুতে সংসদ নির্বাচন হবে।
এর আগে আরপিওতে এমন সংশোধনী আনা হলো।
বর্তমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগ নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
অবশ্য ইসি কর্মকর্তাদের অনেকে বলছেন, সংশোধনীতে ইসির ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এত দিন আইনের এই ধারায় অস্পষ্টতা ছিল। এখন কোন কোন ক্ষেত্রে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।
এই ধারার ব্যাখ্যায় নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এতদিন বলে আসছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা পর্যন্ত যেকোনো সময় ইসি ভোট বন্ধ এবং ফলাফল বাতিল করতে পারে।
তবে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধারায় ৯১(এ) অস্পষ্টতা আছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণার পর তা ইসির কাছে পাঠানো হয়। ইসি সচিবালয় গেজেট প্রকাশ করে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণা করার পর গেজেট প্রকাশ না করে ইসি ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে কি না, সেটি পরিষ্কার নয়। এ কারণে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য ইসি এই বিধানের সঙ্গে আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল।
প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, কোনো অনিয়ম, জোরজবরদস্তি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এলে নির্বাচন কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন করতে পারবে।
তবে ইসিকে পুরো আসনের ফলাফল স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
আইনে বলা হয়েছে, যেসব ভোটকেন্দ্রে (এক বা একাধিক) এসব অভিযোগ থাকবে, ইসি শুধু সেসব কেন্দ্রে ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করে প্রয়োজনে নতুন নির্বাচন করতে পারবে।
এসএইচ-১৭/০৪/২৩ (ন্যাশনাল ডেস্ক)