অবরোধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, নিহত ২

প্রায় আট বছর পর বিএনপি’র ডাকা টানা তিন দিনের অবরোধের প্রথম দিন মঙ্গলবারে বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ,অগ্নিসংযোগ ও ২জন নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, এর মধ্যে ঢাকার মিরপুর এবং নারায়নগঞ্জে পুলিশের সাথে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে।

এদিকে, সকাল থেকে ঢাকার রাস্তায় প্রায় সব ধরনের গাড়ির সংখ্যা কম লক্ষ্য করা গেছে। দূরপাল্লার কোন বাস ছেড়ে যায়নি গাবতলী থেকে।

ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিবিসি সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা খুব একটা দেখা যায়নি, ছিল না চিরচেনা যানজটও।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মোঃ ফারুক হোসেন জানিয়েছেন, মিরপুর এবং নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে।

তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকালে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। পরে তারা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে।

এরপর পুলিশ অবরোধকারীদের সরিয়ে দিতে গেলে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।

এসময় বিএনপি নেতাকর্মীদের ইট-পাটকেলের আঘাতে পুলিশের দুই জন সদস্য আহত হন বলে জানান ডিএমপি মুখপাত্র।

অন্যদিকে, অবরোধের সমর্থনে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় মিছিল বের করে বিএনপি। বেলা ১২টার দিকের এই মিছিল থেকে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টার ঘটনা ঘটে।

সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ঢাকার মহাখালী, বনানী, গুলশান, মিরপুর, আদাবর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, গ্রিন রোড, তেজগাঁও, বিজয় সরণী, ফার্মগেট, নাবিস্কো, পান্থপথ, কলাবাগান, লালমাটিয়া, ধানমণ্ডি, সংসদভবনসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সীমিত সংখ্যক যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক, পিকআপ ভ্যান চলাচল করতে দেখা গেছে।

তুলনামূলকভাবে মিরপুরসহ যেসব এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে, সেসব এলাকায় রাস্তায় মানুষজন এবং যানবাহনের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে।

যদিও পুরো শহরেই ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল লক্ষ্যনীয়ভাবে কম। রাস্তায় রিক্সা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ছিলো স্বাভাবিক দিনের মতোই। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

এছাড়া অবরোধের মধ্যে ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে স্বাভাবিক দিনের মতোই ট্রেন চলাচল করতে দেখা গেছে। যদিও স্টেশনে যাত্রীদের সংখ্যা স্বাভাবিক দিনের চেয়ে কম লক্ষ্য করা গেছে।

মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকার গাবতলী এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়তে দেখা যায়নি। তবে টার্মিনালে বাসের টিকেট কাউন্টারগুলো খোলা ছিলো।

গাবতলী থেকে উত্তরবঙ্গের ২৬টি জেলা এবং দক্ষিণবঙ্গের ২২টি জেলায় প্রতিদিন অন্তত ১২০০ যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে বলে জানিয়েছে টার্মিনাল কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু অবরোধের কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক যাত্রী না পাওয়ায় দূরপাল্লার বাসগুলো ছাড়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাসের টিকেট বিক্রেতারা।

সায়েদাবাদের অবস্থাও একই রকম বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং কর্মীরা।

ঢাকার কদমতলী এলাকায় বোরাক পরিবহনের একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে এ আগুন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।

নৌ-পরিবহনের ক্ষেত্রেও কিছুটা স্থবিরতা লক্ষ্য করা গেছে। মঙ্গলবার সকালে সদরঘাটে অধিকাংশই লঞ্চই ছিল নোঙর করা।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অবরোধের প্রথমদিন সকালে ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের অধিকাংশ লঞ্চই ঢাকা ছেড়ে যায়নি। যাত্রী না থাকায় লঞ্চ ছাড়া হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন তারা। তবে ভোরের দিকে অল্প কয়েকটি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সদরঘাট ছেড়েছে বলে জানানো হয়েছে।

ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং প্রবেশপথগুলোতে পুলিশের সতর্ক অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। এর মধ্যে গুলশান চেকপোস্টে মোটর সাইকেল, গাড়ি এবং সাধারণ মানুষের ব্যাগে তল্লাশি চালাতে দেখা গেছে।

এছাড়া প্রধান সড়কগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় র‍্যাব ও পুলিশের বেশ কয়েকটি দলের টহল চোখে পড়েছে।

ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সরকারি দল আওয়ামী লীগ শান্তি মিছিল করেছে। মিছিলে নেতাকর্মীদের বিএনপি এবং হরতাল-অবরোধ বিরোধী স্লোগান দিতে দেখা গেছে।

এর মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার গাবতলীতে শান্তি মিছিল করেছে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা।

সকাল ১০টার দিকে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে গাবতলী মোড়ে আসতে থাকে দলটির নেতা কর্মীরা। এসময় তাদের কারো কারো হাতে লাঠি-সোটা এবং রড দেখা গেছে।

তবে এখনো পর্যন্ত বিএনপির কোন ঝটিকা মিছিল বা এ ধরণের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।

এদিকে, বিএনপির সাথে অবরোধ ডাকা জামায়াত ঢাকার মহাখালি এবং উত্তরায় ঝটিকা মিছিল করেছে এমন দাবি করে নিজেদের সামাজিক মাধ্যমে পোষ্ট দিয়েছে।

অবরোধের আগের রাতে অর্থাৎ সোমবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং শ্রীপুর উপজেলায় দু’টি বাসে আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এছাড়া মঙ্গলবার ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড থানার সল্টগুলা ক্রসিং এলাকায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস।

এর আগে, সোমবার রাতে নগরীর দামপাড়া ও বালুচরা ট্যানারি বটতলা এলাকায় আরো দু’টি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

শনিবার বিএনপি’র সমাবেশে “হামলা, হত্যা, গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে” এবং সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ে ৩১ অক্টোবর, ১লা ও ২রা নভেম্বর তিন দিনের এই অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি।

বিএনপি বলছে, গত পাঁচ দিনে সারা দেশে বিএনপি’র দুই হাজার ছয়শত নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৪৫টি।

আর গেলো ২৮শে জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৪২টি। যেখানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে।

বিএনপি বলছে, তাদের ভাষায় এসব গ্রেপ্তার, নির্যাতনের অবসান এবং সরকার পতনের দাবি আদায়ের জন্যই তাদের অবরোধের নতুন কর্মসূচি।

নারায়ণগঞ্জ :  নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ৩ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচরুখী বাজার এলাকায় সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে।

আহত তিন পুলিশ সদস্য হলেন—পরিদর্শক হুমায়ুন কবির, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. মতিন ও কনস্টেবল মো. নুরুল।

নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন বলেন, কনস্টেবল নুরুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। পরিদর্শক হুমায়ুন কবিরের ডান হাত কুপিয়ে জখমের পর পিটিয়ে বাঁ হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এএসআই মতিনকে লাঠি ও ইটপাটকেল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। নুরুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বাকি দুজনকে রূপগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখান থেকে পরিদর্শক হুমায়ুন কবিরকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, ৭২ ঘণ্টার অবরোধের সমর্থনে সকাল সাড়ে আটটার দিকে কয়েক শ নেতা-কর্মী নিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মিছিল করেন কেন্দ্রীয় বিএনপির আন্তর্জাতিক–বিষয়ক সহসম্পাদক নজরুল ইসলাম। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাঁশের লাঠি হাতে গাছের গুঁড়ি, আরসিসি খুঁটি ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ তাঁদের বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্য করে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে। অবরোধকারী নেতা–কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়েন।

সংঘর্ষের একপর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা একজোট হয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেন। তিনজন পুলিশ সদস্যকে তাঁরা ধরে ফেলেন। পরে তাঁদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করেন তাঁরা। এ সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন। থানা থেকে আরও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে এলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সড়ক ছেড়ে চলে যান। সংঘর্ষের সময় ঢাকা-নরসিংদী সড়কে চলাচলকারী অন্তত তিনটি বাস ভাঙচুর করেন অবরোধকারী ব্যক্তিরা। প্রায় দেড় ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পুলিশের চেষ্টায় সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।

সংঘর্ষে নিজেদের অন্তত ১৭ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি নজরুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমরা শান্তিপূর্ণভাবেই সড়কে মিছিল করছিলাম। পুলিশ বিনা কারণে আমাদের ওপর হামলা করে। পরে পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন যুক্ত হয়। তাঁরা আমার বাড়িঘরও ভাঙচুর করেছেন।’

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আমির খসরু বলেছেন, বর্তমানে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে। এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করা হয়েছে।

এদিকে অবরোধের প্রথম দিনে রূপগঞ্জের এশিয়ান হাইওয়ে মহাসড়কের কাঞ্চন ও একই মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের নয়াপুর এলাকায় বিএনপির নেতা–কর্মীরা অবরোধের সমর্থনে মিছিল করেছেন।

কিশোরগঞ্জ :  কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা–কর্মীদের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে পুলিশ। তবে বিএনপির দাবি, পুলিশের গুলিতে তাঁদের দুজন নিহত হয়েছেন। আজ মঙ্গলবার সকাল আটটার দিকে উপজেলার ঢাকা–সিলেট মহাসড়কের ছয়সূতি বাসস্ট্যান্ডে এই ঘটনায় দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।

কুলিয়ারচর উপজেলা বিএনপির সভাপতি নুরুল মিল্লাত বলেন, ‘আমাদের মিছিল ছিল খুবই শান্তিপূর্ণ। শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ নির্বিচার গুলি ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে রিফাত ও বিল্লাল নামে আমাদের দুইজন নেতা মারা যান।’

রিফাত উল্লাহ উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি। বিল্লাল মিয়া একই ইউনিয়নের কৃষক দলের সভাপতি। রিফাতের মরদেহ বর্তমানে জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। বিল্লালের মরদেহ ঘটনাস্থলে আছে বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। ঘটনার পর পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

কুলিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম মস্তুফা বলেন, মিছিলকারীরা প্রথমে পুলিশের ওপর হামলা চালান। হামলায় অন্তত ২০ জন আহত হন। তাঁদের অনেকে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। ওসি বলেন, তাঁর জানামতে এ ঘটনায় একজন মারা গেছেন। তবে সেটি গুলিতে, নাকি অন্য কোনো কারণে মারা গেছেন, তা নিশ্চিত নয়।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, অবরোধের প্রথম দিনে আজ সকাল আটটার দিকে ছয়সূতি ইউনিয়ন বিএনপির পক্ষ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নিয়ে উপজেলার ছয়সূতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যাওয়ামাত্র আগে থেকে অবস্থান নেওয়া পুলিশ সদস্যরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে ২০ থেকে ২৫ জন আহত হন।

তবে পুলিশের দাবি, মিছিলকারীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আগে পুলিশের ওপর হামলা করেন। আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ পাশের একটি বাড়িতে অবস্থান নেয়। সেখানে গিয়েও বিএনপির কর্মীরা হামলা করেন। তখন উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তিদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মিছিলকারীরা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন।

বগুড়া : বিএনপির ডাকা তিন দিনের অবরোধের প্রথম দিনে বগুড়ায় পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা পিকেটিংয়ের চেষ্টা করেb। পুলিশ বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। পুলিশ শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে অবরোধ-সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল থেকে বগুড়া সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাফতুন আহমেদ খানের নেতৃত্বে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কয়েক শ নেতা-কর্মী বাঘোপাড়া বন্দরের পাশে পেট্রলপাম্পের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। বেলা ১১টার দিকে বিজিবি, র‍্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শতাধিক সদস্য অবরোধকারীদের সরিয়ে দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়েন। বিএনপি নেতা-কর্মীরা ইটপাটকেল ও ককটেল ছুড়ে পাল্টা জবাব দেন। একপর্যায়ে অবরোধকারীরা পিছু হটে পাশের ইটভাটা হয়ে গা ঢাকা দেন।

এ সময় মহাসড়কে আটকে পড়া দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসসহ বেশ কিছু যানবাহন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গোকুল খোলারঘরের দিকে এগিয়ে গেলে অবরোধকারীরা আবারও মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় গোকুল বন্দরে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের একটি বাস, করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসের একটি কাভার্ড ভ্যানসহ বেশ কিছু যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাঘোপাড়া এলাকায় ফিরে এলে উত্তেজনা দেখা দেয়।

এর আগে সকাল সাতটার দিকে শহরের নওদাপাড়া এলাকায় অবরোধ-সমর্থকেরা সিলেট থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসা হানিফ পরিবহনের একটি বাস, চট্টগ্রাম থেকে গাইবান্ধা অভিমুখী জান্নাত পরিবহনের একটি বাসসহ বেশ কিছু যানবাহন ভাঙচুর করেন। অবরোধকারীদের ইটপাটকেলের আঘাতে জান্নাত পরিবহনের কোচচালক সিদ্দিকুর রহমান (৪৫) আহত হয়েছেন। তাঁকে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকায়।

জান্নাত পরিবহনের চালকের সহকারী মনোয়ার হোসেন বলেন, রাত আটটায় ৪৯ জন যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে গাইবান্ধার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল ছয়টার আগেই গাইবান্ধায় পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু গাজীপুরে যানজটে তিন ঘণ্টা আটকে পড়ায় বগুড়ায় পৌঁছাতেই সকাল সাতটা বেজে যায়। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বগুড়ার নওদাপাড়ায় পৌঁছার পর অবরোধকারীরা লাঠিসোঁটা হাতে বাসে হামলা করেন। যাত্রীরা প্রাণভয়ে চিৎকার–চেঁচামেচি করলে বাস থামিয়ে যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় অবরোধকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে চালক আহত হন।

ভাঙচুর হয়েছে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা দিনাজপুর অভিমুখী হানিফ পরিবহনের একটি বাসও। বাসটিতে একজন বিদেশিসহ ৪০ জন যাত্রী ছিলেন। বাসের যাত্রী নীলফামারীর আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম বলেন, সন্ধ্যা ৭টায় তাঁরা হানিফ পরিবহনের বাসটিতে সিলেট শহরের কদমতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। সকাল ছয়টার মধ্যে দিনাজপুরে পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু গাজীপুরে যানজটে আটকে থাকতে হয়। সকালে বগুড়ায় পৌঁছানোর পর অবরোধকারীরা ইটপাটকেল ছুড়ে বাস আটকে দেন।

একই বাসের যাত্রী দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবির রেজা বলেন, কাল বুধবার থেকে চূড়ান্ত পরীক্ষা। পরীক্ষা দিতেই সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ বাড়ি থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। অবরোধে আটকা পড়ে অবর্ণনীয় দুভোগ পোহাতে হচ্ছে।

একই বাসে যাত্রী ছিলেন লাইফ প্রোজেক্ট ফর ইয়ুথের বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর পোল্যান্ডের তরুণী অ্যালিসন ম্যাগনিজ। তিনি বলেন, সকাল ছয়টায় তাঁর লালমনিরহাটের তুষভান্ডারে পৌঁছার কথা ছিল। পাঁচ ঘণ্টা বাসে আটকা পড়ে আছেন।

এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের বনানী মোড়ে (বেতগাড়ি–লিচুতলা) অবরোধকারীরা বেশ কিছু গাড়ি আটকে দেন। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা অবরোধকারীদের সরিয়ে দিতে গেলে আওয়ামী লীগ-পুলিশ একজোট হয়ে বিএনপির ওপর চড়াও হয়। এ সময় দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে অবরোধকারীরা কয়েকটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করেন। ভাঙচুর করা হয় বেশ কিছু যানবাহন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ।

এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের দুই পাশে সব রকম যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। ঠনঠনিয়া টার্মিনাল ও চারমাথা বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ রুটে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। অন্য কোনো গন্তব্য গন্তব্য থেকেও বাস ছেড়ে আসেনি। তবে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও ওষুধ পরিবহনকারী যানবাহন চলছে।

বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে জনগণ সর্বাত্মক কঠোর অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা মহাসড়কে শান্তিপূর্ণ অবরোধ পালন করলেও পুলিশ বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে।

বগুড়ার শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা বেআইনি কাজ। কোথাও কেউ মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তা সরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে।

এসএইচ-০১/৩১/২৩ (ন্যাশনাল ডেস্ক)