নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা চতুর্থ দফার টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হয়েছে রোববার ভোর ছয়টা থেকে।
অবরোধের প্রথম দিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নয়টি যানবাহনে আগুন লাগানোর তথ্য পাওয়া গেছে। ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতায় পুলিশ হত্যা মামলায় অভিযুক্তসহ বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব ও পুলিশ।
রোববার সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বিবিসির সংবাদদাতারা জানিয়েছেন যে, রাস্তায় বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কারসহ সব ধরনের যান চলাচল করছে, তবে সেটা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম।
গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে হরতাল এবং অবরোধের কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি।
ওই সমাবেশের পরদিন ২৯শে অক্টোবর হরতাল পালন করে বিএনপি, তাতে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো সমর্থন দিয়েছিল।
এরপর ৩১শে অক্টোবর থেকে দোসরা নভেম্বর এবং পাঁচ ও ছয়ই নভেম্বর আরো দুই দফা সড়ক-রেল-নৌপথে সর্বাত্মক অবরোধ বিএনপি। ওই কর্মসূচির পরে আট ও নয়ই নভেম্বর তৃতীয় দফা ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ করে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো।
সর্বশেষ রোববার সকাল ছয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত তারা চতুর্থ দফার অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
এই দফা কর্মসূচি শেষে আবার নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।
গত কয়েক দফায় অবরোধে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ, পরিবহনে অগ্নি-সংযোগ এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে, এসময়ে বিএনপির শীর্ষস্থাণীয় বেশ কয়েকজন নেতা এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিরোধী দলটি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে চতুর্থ দফার এই অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
রোববার ভোর ছয়টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টা এই অবরোধ চলবে।
সংখ্যায় কম হলেও সড়কে বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিক্সাসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবহন চলছে।
অফিস শুরুর সময়ে ঢাকার ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোর সিগনালে গাড়ির জট তৈরি হলেও, বেশি সময় আটকে থাকছে না।
শাহনেওয়াজ রকি সকালে গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে জানিয়েছেন, সকাল থেকে মাত্র একটি বাস ছেড়ে গেছে। গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে মাত্র সাতজন যাত্রীকে নিয়ে বাসটি ছেড়ে যায়। এছাড়া দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।
প্রচুর যাত্রী গত দুইদিনের বন্ধে ঢাকায় এলেও এখন ফিরতে পারছেন না।
চুয়াডাঙ্গার একজন বাসিন্দা বিবিসিকে বলেছেন, “আমি জানতাম আজকে অবরোধ। তাও একটা সুযোগ নিতে এসেছি। অপেক্ষা করছি, যদি কোন বাস ছেড়ে যায়, তাহলে চলে যাবো। ”
অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে শনিবার ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোতে যাত্রীর চাপ দেখা গেছে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকা ছেড়ে গিয়েছেন বহু মানুষ।
সাভারের নবীনগরের আন্তঃজেলা বাস টার্মনালে দেখা যায় ঢাকার বাইরে থেকে আসা অনেক যাত্রী আটকা পড়েছেন।
বাস না পেয়ে তাদের অনেককেই স্বল্প দূরত্বের যানবাহনে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যেতে দেখা যায়।
এদিকে ঢাকার প্রবেশমুখগুলোয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান নিয়ে শান্তি সমাবেশ করতে দেখা গিয়েছে।
তবে বিএনপি অফিসের সামনের পরিবেশ দুপুর পর্যন্ত ছিল শুনশান, সেখানে কোন নেতাকর্মীর আনাগোনা দেখা যায়নি। অফিসের বাইরে ছিল কড়া পুলিশ প্রহরা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্যামা পূজার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি অবরোধ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে বলে বিএনপি জানিয়েছে।
ঢাকার মিরপুরে ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় একটি বাসে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, রোববার বেলা বেলা ১টা ১০ এর দিকে প্রজাপতি পরিবহনের বাসটিতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
খবর পেয়ে মিরপুর ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে চতুর্থ দফার এই অবরোধ শুরুর আগে শনিবার রাতে ঢাকা ও এর আশেপাশেসহ নয়টি স্থানে যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে বলা হয়, শনিবার রাত আটটা থেকে রবিবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ওই আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আটটি বাস, একটি পিকআপ পুড়ে যায়।
এর মধ্যে সাতটি আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা মহানগরে। বাকি দুটি ঘটনা ঘটেছে গাজীপুর এবং বরিশাল সদরে।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
আগুন দেয়ার প্রথম ঘটনাটি ঘটে মতিঝিলের আরামবাগে রাত আটটা কুড়ি মিনিটের দিকে। সেখানে নটরডেম কলেজের বাইরে লাল-সবুজ নামে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া হয়।
পরে সিদ্দিক বাজার ফায়ার স্টেশন থেকে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করছে।
এর দশ মিনিটের ব্যবধানে রাত সাড়ে আটটার দিকে গাবতলি বাস স্ট্যান্ডের সামনে আরেকটি বাসে আগুন দেয়া হয়।
এরপর নয়টার দিকে গুলিস্তানে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া হয়।
রাত সাড়ে নয়টার দিকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার কাছে ফলপট্টির সামনে অনাবিল পরিবহন নামে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া হয়। প
রাত সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর ১৪ নম্বরে কাফরুল থানার সামনে প্রজাপতি পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে।
রাত ১২টার দিকে মিরপুরে রূপনগর থানার সামনে, আরকটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। পরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।
সবশেষ রোববার সকালে ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় মালঞ্চ পরিবারের একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে।
এদিকে রাত সাড়ে নয়টার গাজীপুরের জুগিতলায় একটি পিকআপে আগুন ধরানোর ঘটনা ঘটে সেইসাথে বরিশাল সদরে বিভাগীয় পুলিশ কার্যালয়ের সামনে, মা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।
শনিবার সন্ধ্যায় ফার্মগেট এলাকায় দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে তেজগাঁও থানা পুলিশ। শনিবার সকাল সাতটার দিকে ফার্মগেটের বাবুল টাওয়ারের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
তবে বাসে আগুন দেয়া বা ককটেল বিস্ফোরণ এসব কোন ঘটনায় হতাহতের কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
ফেনী জেলা যুবদলের সভাপতি জাকির হোসেন জসিম এবং সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খন্দকারসহ চার জনকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
শনিবার রাত ১১টার দিকে ফেনীর সদর এলাকা থেকে জাকির হোসেন জসিমকে গ্রেফতার করার কথা বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন র্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম।
ঢাকায় গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
র্যাবের সহকারী পুলিশ সুপার ইমরান খান জানিয়েছেন, শনিবার রাতে ফেনী মডেল থানার ইসলামপুর এলাকায় ককটেল বোমা বিস্ফোরণ ও নাশকতা মামলায় নাসির উদ্দিন খন্দকারসহ আরও তিনজনকে ফেনী সদর থেকে গ্রেফতারের করা হয়েছে।
আটকের পর তাদেরকে ফেনী মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে, একই মামলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ইউসুফ আলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাব মিডিয়া শাখার উপ পরিচালক লুৎফুল হাদি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
বিএনপি দাবি করছে, ঢাকাসহ সারাদেশে মামলা এবং পুলিশের অভিযানে এ পর্যন্ত দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ১২ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে।
বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল এবং কোথাও কোথাও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করার কথা জানিয়েছে।
বিএনপি মিডিয়া সেল থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এছাড়া শনিবার রাতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ,গাজীপুর, বাগেরহাট, নারায়ণগঞ্জ, পিরোজপুর, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, নোয়াখালীসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলায় মশাল মিছিল করেছে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এদিকে সিলেটের জকিগঞ্জে রোববার সকালে সুরমা সংযোগ সড়কে গাছের গুঁড়ি, বাঁশ ফেলে তারা যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
গত ২৯শে অক্টোবর বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের ওপর হামলার জেরে দায়েরকৃত মামলায় সিলেট মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মামুনুর রশীদকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে জকিগঞ্জ থানা পুলিশ।
এদিকে, অবরোধ চলাকালে সারাদেশে সার্বিক নিরাপত্তা জোরদারের কথা জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেছেন, রোববার এবং সোমবারের অবরোধে নাশকতা রোধে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, অবরোধ শুরুর আগে ও চলার সময় চোরাগোপ্তা হামলাকারীদের ধরতে ঢাকার গণপরিবহনগুলোয় যাত্রী বেশে অবস্থান করবেন গোয়েন্দা সদস্যরা। সেই সঙ্গে ঢাকাজুড়ে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোতেও সার্বক্ষণিক নজর রাখা হবে বলে তিনি জানান।
ঢাকায় প্রতিটি মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন করা আছে, তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে, অবরোধের মধ্যেও ঢাকাসহ সারা দেশে সব রুট বাস-মিনিবাসসহ সব ধরনের গণ-পরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই ঘোষণা দেয় সংগঠনটি।
এর আগে বিএনপির পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অবরোধে গণমাধ্যম ও সংবাদপত্র বহনকারী গাড়ি, জরুরি সেবায় নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স চলাচল, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ওষুধ বহনকারী যানবাহন অবরোধ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।
এসএইচ-০২/১২/২৩ (ন্যাশনাল ডেস্ক)