জাতীয় পার্টিতে নতুন নাটক

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের পক্ষের দ্বন্দ্ব নতুন করে সামনে এসেছে। দলটি থেকে নির্বাচন কমিশনে আলাদা দুটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। মহাজোট থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন রওশন। তবে জিএম কাদেরের বক্তব্য হলো, তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী বাছাই বা মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। ফলে তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন।

ইসিতে পাঠানো চিঠিতে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, জাতীয় পার্টি বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ওই দিন বিকেলে জানা যাবে এই নির্বাচনে কোন দল অংশ নিচ্ছে আর কারা নিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা ১৮টি রাজনৈতিক দল ভোটে অংশ নেবে বলেছে। আরও ১২টি দল এখনো কিছু জানায়নি। অন্য দিকে বিএনপি ও তাদের সমমনা ১৪টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে বলছে।

বিএনপি ভোটের বাইরে থাকলে জাতীয় পার্টির ভোটে আসা না আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনের পরিকল্পনায় জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীনদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই দলকে নিয়ে কৌতুহল আছে? অনেকেই মনে করছেন, জাতীয় পার্টি সম্প্রতি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে যা ভোটে না যাওয়ার ইঙ্গিত। আবার অনেকের মতে, শেষ পর্যন্ত দলটি ভোটে যাবে। তারা আওয়ামী লীগের অধীনে হওয়া কোনো ভোট বর্জন করবে না।

জাতীয় পার্টি শনিবার নির্বাচন কমিশনে দুটি চিঠি দিয়েছে। এর মধ্যে একটি চিঠি দিয়েছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। আর অন্যটি দিয়েছেন দলের চেয়ারপারসন জি এম কাদের।

রওশন তাঁর চিঠিতে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেবে। অন্যদিকে জি এম কাদের ইসিকে জানিয়েছেন, তাঁর সই ছাড়া জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী দলের মনোনয়নে নির্বাচন করতে পারবেন না। এই দুটি চিঠির পর জাতীয় পার্টিতে দুই পক্ষের বিরোধ আবারও সামনে এসেছে। দলটি শেষ পর্যন্ত ভোটে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।

এই দুটি চিঠির পর নিজেদের করণীয় কি হবে তা নিয়ে খোদ ইসিতে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। দুটি চিঠি আলাদাভাবে কেন এল না নিয়ে চলছে আলোচনা। ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেছেন, জাতীয় পার্টির পাল্টাপাল্টি চিঠি নির্বাচন কমিশন বিবেচনা করবে। তবে প্রার্থী ও প্রতীক চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে দলের চেয়ারম্যান, মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদের সাক্ষরিত চিঠি বিবেচিত হবে।

শনিবার বনানীতে কথা হয় জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতার সঙ্গে। তাঁরা বলছিলেন, এটা ঠিক যে জাতীয় পার্টি ভোটে যাওয়া নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো পর্যন্ত দেয়নি। তবে দলটির সব কার্যক্রম জুড়েই ভোটে যাওয়ার প্রস্তুতি আছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম ছাপানোর কাজ শেষ হয়েছে। এবার মনোনয়ন ফরমের দাম গত বারের তুলানায় ৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা করা হয়েছে। কার সইয়ে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হবে সেটা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হয়, সেটাও জানানো হয়েছে। তা ছাড়া এখন দিনভর যেসব কার্যক্রম চলছে তা মূলত নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি বলা যায়। তা ছাড়া আগের দুটি নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে। এমনকি তিন’শ আসনে দলীয় প্রার্থী কারা হবেন তা নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে।

তবে ওই নেতারা বলেন, তাঁরা মনে করছেন আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে সব বিষয় পরিস্কার হয়ে যাবে। তাঁরা বলেন, দলের কেউ কেউ, বিশেষ করে যাদের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম তাঁরা মনে করেন ভোটে যাওয়ার দরকার নেই। তবে বর্তমান সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগই ভোটে যাওয়ার পক্ষে।

এক নেতারা কাছে প্রশ্ন ছিল, সব সময় ভোটের আগে জাতীয় পার্টি কি করবে এমন একটা আলোচনা কি ইচ্ছে করেই তোলা হয়? ওই নেতা বলেন, রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির একটা গুরুত্ব আছে। বিশেষ করে শেষ দুটি নির্বাচনের আগে বিএনপি যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। তখন থেকেই জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বেড়েছে। তিনি বলেন, বিএনপির বিষয়টি তো আলোচনা থাকেই। এই দলটি তো ২০১৮ নির্বাচনে যাবে না বলেও পরে এসেছিল। তাই শুধু জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে এমন আলোচনা ওঠা মোটেই যৌক্তিক না।

এবার জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দল, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে না কিংবা তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতেও কোনো আন্দোলন করছে না। তাহলে ভোটে যাওয়া নিয়ে ধোঁয়াশা কেন? জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “এখানে ধোঁয়াশার কিছু নেই। জাতীয় পার্টি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বুঝে–শুনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা এখনো ভোটে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিইনি এটা ঠিক। তবে ভোটের সব প্রস্তুতি আছে। পরিস্থিতি ভোটের উপযোগী হলে জাতীয় পার্টি ভোটে যাবে। না হলে যাবে না। এ ব্যাপারে দলের অবস্থান শিগগিরই জানানো হবে।”

দলটির একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, আসলে দলের সাবেক চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ মারা যাওয়ার পর দলের মধ্যে ভাবী–দেবরের (রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের) সুস্পষ্ট একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। দলে দুটি পক্ষও তৈরি হয়েছে। রওশন এরশাদের অবস্থান ভোটে যাওয়ার পক্ষে। জি এম কাদের অবস্থান কিছুটা আলাদা। এ কারণে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দিতে দেরি হচ্ছে। তবে ওই নেতা মনে করেন, জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাবে। দল মনে করে নির্বাচনের বাইরে থেকে লাভ নেই।

শনিবার জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে নেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় কুমিল্লা থেকে এক নেতা সেখানে আসেন। তিনি এক সময় উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন বলে জানালেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তিনি জানতে চান, ভোট কী জাতীয় পার্টি এককভাবে করবে, না আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধবে। উত্তরে এক নেতা বললেন, এখানে সাংবাদিক আছে। আগে প্রশ্ন করেন জাতীয় পার্টি ভোটে যাবে কি না।

এসএইচ-০৭/১৮/২৩ (ন্যাশনাল ডেস্ক)