জীবিত হয়েও ভোটার তালিকায় মৃত!

পঞ্চগড়ে প্রধান শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতাধিক জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটে ফেলা হয়েছে। এ অবস্থায় বাস্তবে জীবিত ব্যক্তিরা পড়েছেন বিপাকে। ভোটার তালিকায় নাম না থাকায় ভোটাধিকার প্রয়োগ, ব্যাংক ঋণ গ্রহণ, করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিতে পারছেন না তারা। অন্যদিকে নির্বাচন অফিসে ফের তালিকাবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করলেও, এখন পর্যন্ত কোনও ফল পাননি তারা।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাসহ দ্রুত তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।

জেলার বোদা উপজেলার ঝলইশালশিরী ইউনিয়নের ধরধরা প্রধানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জীতেন্দ্র নাথ বর্মন (এনআইডি নম্বর-…….৩২৪৭৯) ২০০৮ সালে ভোটার তালিকায় লিপিবদ্ধ হন। পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আপন ছোট ভাই অজিতকে ভোট দিতে পারেননি তিনি। জীবিত থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠদানসহ স্বাভাবিক সব কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও নির্বাচন কমিশনের সার্ভার থেকে তার নাম কাটা হয়েছে। সার্ভারে কোনও তথ্য নেই, তাকে মৃত দেখানো হয়েছে।

বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিস ২০১২ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদে জীতেন্দ্রনাথকে মৃত দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটে ফেলে। নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে নাম না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন ইএফটিতেও (ইলেকট্রিক ফান্ড ট্রান্সফার-বৈদ্যুতিক তহবিল স্থানান্তর) নাম নিবন্ধন করতে পারেননি তিনি। এর ফলে বেতনভাতা হচ্ছে না, ফিক্সেশনও হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ইএফটি করতে গিয়ে অনলাইনে তার আবেদন এক্সেপ্ট হচ্ছে না। তখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নির্বাচন অফিসের ভোটার তালিকায় তার নাম নেই। তাকে মৃত দেখানো হয়েছে।

অন্যদিকে জেলার বোদা উপজেলার বোদা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নগরকুমারী এলাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন মনু (এনআইডি নম্বর …….৩২৩৪৫৪) ২০০৮ সালে ভোটার হন। কিন্তু ২০১৭ সালে বোদা পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। ভোটার তালিকায় নাম ছিল না তার। উপজেলা নির্বাচন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে তার নাম নেই। বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিস ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদে তাকে মৃত দেখিয়েছে এবং ভোটার তালিকা থেকে তার নাম কেটে ফেলা হয়। নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে নাম না থাকায় ব্যাংকে ঋণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন তিনি। এছাড়া কোভিডের টিকার রেজিস্ট্রেশনও তিনি করতে পারেননি।

পঞ্চগড় জেলার পাঁচ উপজেলায় জীবিত যেসব মানুষকে মৃত বানানো হয়েছে। তারা হলেন-জেলার বোদা উপজেলার বোদা পৌরসভার নগরকুমারী গ্রামের বাসিন্দা ভারতী (এনআইডি নম্বর- …….৩২৩৭৮৩), বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মো. অছিরউদ্দিন (এনআইডি নম্বর- …….৩৮৮৩৭৭), একই উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়নের কামারপাড়া গ্রামের সনেবালা (এনআইডি নম্বর- …….৩৬২৯৪০), ঝলইশালশিরী ইউনিয়নের মাঝাপাড় গ্রামের মোছা. নারগিছ (এনআইডি নম্বর- …….৩৩০৯১৭), ঝলইশালশিরী ইউনিয়নের কালিয়াগঞ্জ গ্রামের জিরন বালা (এনআইডি নম্বর- …….২৫৫১৩৩৯২৭), ঝলইশালশিরী ইউনিয়নের লাঙ্গলগাঁও গ্রামের কাহাবানী (এনআইডি নম্বর-…….৩৩৫৮৬৪), চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের কুমারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলী (এনআইডি নম্বর-……..৪১৫৮৩৯), একই গ্রামের মো. আজিমউদ্দিন (এনআইডি নম্বর-…….৪১৬৯৯৯), একই গ্রামের মো. মকবুল হোসেনসহ (এনআইডি নম্বর- …….৪১৫৭৩৮) পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসে ১২ জন, তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসে চার জন এবং আটোয়ারী উপজেলা নির্বাচন অফিসে একজনকে জীবিত থেকে মৃত দেখানো হয়েছে।

সমাজসেবা অধিদফতর মিস-ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের ভাতা দেওয়ার কার্যক্রম হাতে নেওয়ায় অনলাইন ডাটাবেজ তৈরি করছে। তবে অনেকের ডাটা অসম্পূর্ণ দেখাচ্ছিলো। ওই সব সুবিধাভোগীরা নির্বাচন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ভোটার তালিকায় তাদের নাম কাটা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতরের চলমান এ কার্যক্রম শেষ হলে জীবিতকে মৃত বানানোর সংখ্যার আরও তথ্য বেরিয়ে আসার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পঞ্চগড় সদর, বোদা তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী উপজেলা নির্বাচন অফিস ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের সময় এসব জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটে ফেলা হয় বলে জানা যায়।

শিক্ষক জীতেন্দ্র নাথ বর্মন বলেন, বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিস ২০১৪ সালে আমাকে মৃত ঘোষণা করে। তবে কোন শিক্ষক (তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজার) তার তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং মৃত হিসেবে ভোটার তালিকা থেকে কাটার জন্য কে বা কারা আবেদন করেছেন, তা তাকে জানাতে পারেননি। উপজেলা নির্বাচন অফিসের কাছে এ সংক্রান্ত কোন তথ্য বা কাগজপত্র নেই বলে তাকে জানানো হয়। জীবিত মানুষটিকে কারা কিভাবে মৃত বানালো এর দায়ভার কার প্রশ্ন তার।

ভুক্তভোগী মনোয়ার হোসেন মনু জানান, আমি জীবিত আছি। স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছি। ব্যবসা-বাণিজ্য করছি। আমাকে কেন মৃত হিসেবে ভোটার তালিকা থেকে নাম কর্তন করা হলো তার বিচার চাই। কে আমাকে মেরেছে, এ বিষয়ে তদন্ত করা হোক।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের কথার মূল্য নাই। আমাকে একাধিকবার হয়রানি করেছে। ভোটার তালিকায় পুনরায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিসে আবেদন করেছি। আড়াই মাস পরও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কারা কিভাবে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে তার কোনও কাগজপত্রও দেখাতে পারেনি। এ বিষয়ে সুষ্ঠু কোনও সমাধানের কথাও জানাতে পারেনি। বারবার যোগাযোগ করে এখন পর্যন্ত কাজ না হওয়ায় আমি হতাশ হয়ে পড়েছি।

জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ী ইউনিয়নের কুমারপাড়া এলাকার ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশরাফুল ইসলাম জানান, তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজাররা যাচাই-বাছাই না করে লোকমুখের কথা শুনে জীবিত ব্যক্তিদের মৃত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, এটা কি মগের মুল্লুক নাকি। তাদের ভুলের কারণে আমার বৃদ্ধ বাবার ভাতা আটকে গেছে। শুধু আমার বাবা নয় নির্বাচন অফিস আমাদের এলাকার আরও ৩/৪ জন জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়েছে। এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে কারা কারা জড়িত এজন্য তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

বোদা পৌরসভার প্যানেল মেয়র মো. খাদেমুল ইসলাম জানান, মনোয়ার হোসেন মনুকে পুনরায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়েছে।

বোদা উপজেলার ঝলই শালশিরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান, আমার এলাকার প্রায় ১০/১২ জন জীবিত লোককে মৃত বানানো হয়েছে। আমি ইতোমধ্যে ৫/৭ জনকে পুনঃভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উপজেলা নির্বাচন অফিসে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে আবেদন করিয়েছি।

বোদা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম সরকার জানান, আমি কিছুদিন হলো এখানে যোগদান করেছি। আমি অনেক বিষয় বলতে পারবো না। এগুলো কিভাবে হয়েছে তা আমার জানা নেই। আগের কোনও ডকুমেন্টও অফিসে নেই। তবে ভোটার তালিকায় পুনরায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য বেশ কিছু আবেদন দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি আসতে পারে। যেসব আবেদন পেয়েছি সেগুলো আমি জেলা নির্বাচন অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। জেলা কর্মকর্তার সুপারিশের পর এসব আবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হবে। ১২ নম্বর ফরমে তথ্য প্রাপ্তির পর মৃত ব্যক্তিদের নাম ভোটার তালিকা থেকে কর্তন করা হয়। ১২ নম্বর ফরমে তথ্যসংগ্রহকারী, ইউপি সদস্য এবং চেয়ারম্যানের সিল স্বাক্ষর থাকে বলে তিনি জানিয়েছেন।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলমগীর জানান, মৃত্যুজনিত কারণ ছাড়া অন্য কোনও কারণে কারও নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যায় না। হালনাগাদ করার সময় কোনও ডিজিট ভুলের কারণে বা তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজাররা ভুলবশত এমনটি করতে পারে। আমি বোদা উপজেলা থেকে এমন ২০টি আবেদন পেয়েছি যেগুলো নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কে কিভাবে এটি করলো বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসএইচ-০৬/১৭/২১ (উত্তরাঞ্চল ডেস্ক)