মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ২২ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মাজেদা খাতুন। বছরের পর বছর খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাননি স্বজনরা। সন্তানরা ধরে নিয়েছিলেন তাদের মা আর বেঁচে নেই। দুই দশক পর মাকে ফিরে পেলেন ৮ সন্তান। দীর্ঘ সময় পর মাজেদা বাড়ি ফেরায় আনন্দের জোয়ার বইছে গ্রাম জুড়ে। আপ্লুত পরিবারের সদস্যরা। তাকে দেখতে ছুটে আসছে বিভিন্ন এলাকার মানুষ৷ তবে বৃদ্ধা মাকে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য না থাকায় অসহায়ত্বের ছাপ সন্তানদের চোখমুখে৷
মাজেদা খাতুনের বাড়ি উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে। তিনি সদর উপজেলার সাতমেড়া ইউনিয়নের বোদাপাড়া গ্রামের মৃত বছির উদ্দিনের স্ত্রী। ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ের জননী মাজেদা ২০০১ সালে স্বামী-সন্তান রেখে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হন।
শনিবার দুপুরে মাজেদা খাতুনের বড় ছেলে ফজলুল হকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির উঠোনে একটি চেয়ারে বসা তিনি। তাকে দেখতে সেখানে শতশত উৎসুক মানুষের ভিড়। তবে কাউকেই চিনছেন না এই বৃদ্ধা। এমনকি ৮ সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে এবং এক ছেলে ছাড়া বাকীদেরও চিনছেন না তিনি।
এর আগে, শুক্রবার তাদের এক স্বজন পার্শ্ববর্তী তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট ইউনিয়নের ইসলামবাগ এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য আফাজ উদ্দিনের বাড়িতে মাজেদা বেগমকে দেখতে পান এবং চিনতে পারেন পরে সেই স্বজন সাথে সাথে মাজেদার বাড়িতে খবর দিলে রাতেই ছুটে যায় সন্তানরা। পরে সেখানে মাকে চিনতে পারেন সন্তানরা।
এ সময় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, আশ্রয়দাতা ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় মাজেদাকে। সেখানে গত ৪ বছর ধরে অবস্থান করছিলেন বলে জানান স্বজনরা। এদিকে বছরের পর বছর খোঁজাখুঁজি করেও কোনো সন্ধান না পেয়ে তার ভেবেছিলেন মা আর বেঁচে নেই। এছাড়া স্ত্রীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ২০০৯ সালে মারা যান স্বামী বছির উদ্দিন।
হারানো মাকে খুঁজে পেয়ে খুশি সন্তানরা। তবে মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় বৃদ্ধা মাজেদার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু স্বল্প আয়ের সন্তানরা চিকিৎসার ব্যয় জোগাড় করতে না পেরে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। তবে মাজেদার পাশে সরকার কিংবা সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তারা।
মাজেদা খাতুনের বড় ছেলে ফজলুল হক জানান, ২০০১ সালে তার বয়স ২০-২১ চলছিলো। সবে বিয়ে করেছিলেন তিনি, এর মধ্যেই নিখোঁজ হয়ে যান তার মা। বছরের পর বছর খোঁজাখুঁজি করেও কোন সন্ধান না পেয়ে ধরেই নিয়েছিলেন তার মা বেঁচে নেই। তার মায়ের অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ২০০৯ সালে মারা যান বাবা বছির উদ্দিন।
ফজলুল হক বলেন, মা যখন নিখোঁজ হন তখন আমার ভাইবোনরা অনেক ছোট ছিল। তারা মায়ের আদর-যত্ন সেভাবে পায়নি। মা ফিরে আসবে এমন আশা আমরা ছেড়ে দিছিলাম। এখন ফিরে আসায় আমরা কী পরিমাণ আনন্দিত তা বলে বুঝাতে পারবো না।
ফজলুল হকের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ফারজানা বলেন, দাদিকে কখনো দেখিনি, উনি আছে এটাও জানতাম না। পাড়ার অন্য দাদিদের সঙ্গে যখন কথা বলতাম তখন নিজের দাদির খুব অভাববোধ করতাম। হঠাৎ করে কালকে দাদিকে পেয়েছি, এটা অনেক বড় পাওয়া। আমরা সবাই খুব খুশি।
মাজেদা বেগমের ছোট ছেলে মফিদার রহমান বলেন, ৫-৬ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছি। ছোট থেকেই মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। এতদিন পর মাকে পেয়েছি, কিন্তু আমার মা আমাকে চিনতে পারছেনা- বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, আমার মা এখনো মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি সুস্থ হলে সবাইকেই চিনবেন বলে আশা করি।
স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক নুরুজ্জামান বলেন, তিনি সম্পর্কে আমার চাচি হন। তার ফিরে আসার খবরে ছুটে এসেছি, এসে দেখলাম তিনি এখনো ভারসাম্যহীন। তার সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু তার সন্তানরাও তেমন সচ্ছল নয়। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
সদর উপজেলার সাতমেড়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জহিরুল ইসলাম বলেন, গতকাল খবর পাই এই বৃদ্ধা তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট ইউনিয়নে আছেন। পরে তার ছেলেসহ সেখানে যাই এবং তাকে নিয়ে আসি। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ, তার এখন সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময় খোঁজখবর রাখবো এবং ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যেকোনো সুযোগ-সুবিধা এলে তাকে দেয়া হবে।
এসএইচ-১১/১৫/২৩ (উত্তরাঞ্চল ডেস্ক)