প্রাচীন জনপদ শ্রীলঙ্কা। ২৫ হাজার বর্গমাইল নিয়ে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত এই দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। বসবাস করেন ২ কোটি ২০ লাখ মোট জনসংখ্যার ৭১ শতাংশ বৌদ্ধ, ১১ শতাংশ হিন্দু, ১০ শতাংশ মুসলমান আর ৮ শতাংশ খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী। শ্রীলঙ্কার মাটিতেই প্রথম মানব আদমের আবির্ভাব হয় বলে জনশ্রুতি আছে। যেটি এখন আদম চূড়া বা আদম পিক হিসেবে পর্যটকদের কাছে পরিচিত। তবে, আদমের এই পদচিহ্নকে বৌদ্ধরা বলে ‘শ্রীপদ’ যা বুদ্ধের পবিত্র পদচিহ্ন হিসেবে বিশ্বাস করে। হিন্দুরা মনে করে এটি শিবের পদচিহ্ন। অন্যদিকে খ্রীস্টান আর মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করে এটি আদি পিতা আদমের পদচিহ্ন।
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার জনগণ যুদ্ধহামলা, গৃহযুদ্ধ কিংবা সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে সেই দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত! ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া গোষ্ঠীকে খেদিয়ে স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৭০ দশকে দেশটি সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে। প্রায় তিন দশকের গৃহযুদ্ধ আর রাজনৈতিক চড়াই-উতরাইয়ের পরও তারা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল বেশ দারুণভাবে কার্যকর। আর তাই অনেকে ভেবেছে, সব নৃশংসতাকে তারা পেছনে ফেলে এসেছে।
কিন্তু তাদের রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শিতা ও স্বার্থসিদ্ধি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। দেশী-বিদেশী নানা ধরনের চাটুকার ও ফন্দিবাজদের দিয়ে সবকিছু বেসরকারীকরণ ব্যবস্থায় তারা ছিল অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে চীনের বাণিজ্যনীতি চাপিয়ে দেয়ায় তাদের মাঝে কিছুটা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কারণ দেখা গিয়েছিল। আবার অন্যদিকে ২০১৮ সালের মার্চে বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু মুসলমানদের বাড়ি এবং সম্পত্তিতে হামলা চালানোর ঘটনাগুলো তাদের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতাও তৈরি করে। কিন্তু ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা’ ‘সব ধরনের নৃশংসতাকে পেছনে ফেলে এসেছে’- তাদের এই বিশ্বাসে ধীরে ধীরে চিড় ধরিয়েছে। শুধু চিড় ধরিয়েছে বললেও হবে না, সা¤প্রতিক আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলায় তারা এখনও সেই বর্বরতা থেকে মুক্ত হয়নি- এটিও রীতিমতো পরিষ্কার হয়েছে। কারণ, ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডের মতো খ্রীস্টানদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের দিনে শ্রীলঙ্কাজুড়ে গির্জা ও বিলাসবহুল হোটেলের আটটি জনবহুল স্পটে বিস্ফোরক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই হামলায় শেষ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন’শ-এর বেশি। আর আহত হয়েছে প্রায় পাঁচ’শ জনের মতো।
এদিকে এই মৃতের সংখ্যার তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশী শিশু জায়ান চৌধুরীও। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাত ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি আট বছরের জায়ান চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে গিয়ে হোটেলে বোমা হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ওই হামলার ঘটনায় শিশু জায়ানের বাবা মশিউল হক চৌধুরী প্রিন্সও আহত হয়েছেন।
২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসীদের আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা আর বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। খোদ শ্রীলঙ্কার সরকারও বলছে, এই ধরনের হামলা তাদের দেশের উগ্রপন্থীদের পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। ওই হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক জড়িত।
অনেক জায়গা থেকে এর যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছি। এই ধরুন, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে বন্দুকধারীর সন্ত্রাসী হামলার মাত্র পঁয়ত্রিশ দিন পার হতে না হতেই শ্রীলঙ্কায় গির্জায় এবং আবাসিক হোটেলে ধারাবাহিক আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনার কোথাও একটা যোগসূত্র থাকতে পারে। যদিও এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলার দৃশ্যপট ইতোপূর্বে আরও দেখা গেছে। যেমন, নিউজিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার পূর্বে গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সের (জিটিআই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ১০৬টি দেশ এই ধরনের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের হামলার নেপথ্যে কী ছিল এটি খোদ হামলাকারী তার ৭৩ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত উল্লেখ করেছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৪০ জন মুসল্লিকে হত্যা করেছেন ব্রেন্টন ট্যারেন্ট নামে অস্ট্রেলিয়ার এক শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী। ব্রেন্টন ট্যারেন্ট নামে তার টুইটারে আপলোডকৃত হামলার পরিকল্পনা ৭৩ পাতার ইশতেহারে বলেন, আমি মুসলিমদের অপছন্দ করি। আমি সে সব মুসলিমকে ঘৃণা করি, যারা অন্য ধর্ম থেকে এসে মুসলিম হয়। জানা যায়, ২০১১ সালে নরওয়ের অসলোতে এ্যান্ডারস ব্রেভিক নামে এক সন্ত্রাসীর হামলায় ৭৭ জন নিহত হয়েছিলেন। ব্রেন্টন ট্যারেন্টের ওই ঘটনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিউজিল্যান্ডে এ হামলা চালায়। এই সন্ত্রাসী নিউজিল্যান্ড হামলা করতে কীভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছে- এটি তার ৭৩ পৃষ্ঠার ইশতেহারের চেয়ে আমার কাছে মনে হয়ে এটি একটি মুভির গল্পের দৃশ্যায়ন যা ১৯৯৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সভিওর’-এর। এই লেখার আগেও আরেকবার এই মুভিটি দেখে নিয়েছি।
১৯৯৮ সালেই ‘সভিওর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মুসলমানকে টার্গেট করে আইএসকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও সেই সময়ে আল কায়েদা বা আইএস অতটা শক্তিশালী বা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়নি। আরও একটু গভীরে প্রবেশ করলে দেখবেন, এই ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনকে কারা পৃষ্ঠপোষক করে থাকে। কোন রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান অর্থ, অস্ত্র দিয়ে থাকে- এটি এখন আর অজানা নয়।
তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের উগ্রবাদের উত্থান, ধরন, আদর্শিক ভিত্তি, দমন ও নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নিয়ে নানান ধরনের বিতর্ক আছে। আর সমন্বিত সন্ত্রাসবাদী হামলার চিত্র দক্ষিণ এশিয়ায় খুব একটা দেখা যায়নি আগে। নিকট অতীতে মুম্বাইয়ে হামলা আর বাংলাদেশে সিরিজ বোমা হামলার কথা সবার মনে থাকার কথা। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) যুগপৎ বোমা হামলা চালিয়েছিল জেএমবি। তখন ওই সিরিজ বোমা হামলা করতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করেছিল। ফান্ডের বেশির ভাগ টাকা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে সংগ্রহ করলেও বাকি অর্থ যোগার করেন যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত একটি রাজনৈতিক দল থেকে।
এই ধরনের হামলা কেন, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে গিয়ে দেখি, উগ্রবাদী সংগঠনগুলো সাধারণত তাদের শক্তির জানান দিতেই এ ধরনের সমন্বিত হামলা সংঘটিত করে থাকে। একইসঙ্গে কয়েক জায়গায় হামলা করার মতো তাদের শক্তি আছে এবং সাংগঠনিকভাবেও তারা শক্তিশালী-এটা বোঝানোই হচ্ছে তাদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য। আর দিনক্ষণ ঠিক করে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা, কোন্দল এবং নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো দক্ষতায় দুর্বলতা দেখা দিলে কিংবা কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে অর্থের বিনিময় করে অথবা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রযন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হলে।
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের শাসনামলের কথা বাংলাদেশের মানুষ কখনও ভুলতে পারবে কিনা জানি না। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড ছুড়ে দলের ২৪ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করলেও তাদের প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই পুরো জাতিকে জিম্মি করতে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনাটি ঘটিয়েছে। কারণ, সিরিজ বোমা হামলাকারী জেএমবিকে খোদ তখনকার সরকার বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি বলেও বাংলাভাইদের মতো জঙ্গীদের আড়াল করতে পারেনি সরকার প্রধান খালেদা জিয়া। অন্যদিকে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে জজ মিয়ার নাটকের দৃশ্যায়ন করার চেষ্টা করেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এখানেও সরকার ও সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রের দক্ষতায় দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। আর এ সুযোগটাই নিয়েছে স্বার্থান্বেষী মহল। আর ব্যবহার করেছে আদর্শভিত্তিক ব্যক্তি ও সংগঠনকে।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশে সিরিজ বোমা হামলাটি ছিল শাসকগোষ্ঠী সমর্থিত বা রাষ্ট্র পরিচালিত উগ্রবাদের। কিন্তু আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ককে দায়ি করলেও শ্রীলঙ্কার হামলার নেপথ্য এখনও স্পষ্ট নয়, তবে আদর্শভিত্তিক ব্যক্তি ও সংগঠন এখানে ব্যবহৃত হয়েছে যা আইএসের দায় স্বীকারের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, উগ্রবাদের ভিত্তি কেবল ধর্মীয় আদর্শই নয়; উগ্রবাদের আদর্শিক ভিত্তি নিজ নিজ ধর্ম ছাড়াও বর্ণ, জেন্ডার, জাতীয়তাবাদী চেতনা, রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক মতাদর্শও রয়েছে। আদর্শভিত্তিক উগ্রবাদের মদদদাতা কারা, কিংবা কেনইবা আদর্শভিত্তিক এই বিভাজন প্রকট হয়ে পড়ছে বা ছড়িয়ে দিচ্ছে- এগুলো বিচার-বিশ্লেষণ কিংবা গবেষণার দাবি রাখে।
আর্থ-সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোর অদক্ষতা, দুর্বলতা আর সরকারের মাঝে সমন্বয়হীনতার সুযোগ বুঝেই আদর্শভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলো এ ধরনের সমন্বিত হামলা সংঘটিত করে থাকে, যার উদাহরণ ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলা। যা থেকে সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। আর ইতোমধ্যেই (২৭ এপ্রিল) আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রকাশিত একটি পোস্টারে বাংলায় লেখা রয়েছে ‘শীঘ্রই আসছি…’।
অর্থাৎ নতুন প্রকাশ করা এই পোস্টার থেকে ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গী সংগঠনটির পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে বাংলাদেশ বা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অথবা দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশ। তাই অগ্রিম সতর্কতা, সম্ভাব্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠীদের নজরদারি এবং সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো একে অপরের সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত আর কর্মকান্ডের সমন্বয় তৈরি করতে হবে।
এসএইচ-৩৪/০৬/১৯ (কবীর চৌধুরী তন্ময়, লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ), পূবর্ পশ্্্চিম, লেখকের নিজস্ব মতামত। এই মতামতের সাথে অামাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই)