নারীর উন্নয়ন ঘটলেই জাতির উন্নতি সম্ভব

একথা দুঃখজনক হলেও সত্যি যে,বর্হিবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশে নারীর উন্নয়নের পথ সুগম হলেও বন্ধ হচ্ছে না নারী নির্যাতন কিংবা নারীর প্রতি সহিংসমূলক আচরণ।

দ্যা গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ১৪৪টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। এক্ষেত্রে ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১০৮, ১০৯, ১১১, ১২৪ ও ১৪৩তম। কাজেই নারীর ক্ষমতায়ন একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কেবল ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে নয়,অর্থনৈতিক সামাজিক,রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক সহ বিভিন্ন অঙ্গনেও নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।সচেতন নারী শিক্ষিত হবার পাশাপাশি খেলাধূলাতেও অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে।বর্হিবিশ্বে সে আলোড়নও তারা ঘটিয়েছে। এতদসত্ত্বেও আমাদের দেশে নারীদের ওপর নির্যাতন কিংবা সহিংসতা প্রতিরোধ হচ্ছে না।

২০১১ সালে সরকারি প্রতিবেদনে দেখা যায় কর্মস্থলে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ১৬ দশমিক দুই শতাংশ। আশ্চর্য জনক হলেও সত্য নারীরা সবচাইতে বেশি তাঁর ঘরে নির্যাতিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে পরিবারে নির্যাতিনের শিকার নারীর সংখ্যা প্রায় ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ঘরে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ীর লোকজনের কাছেই নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

প্রতিবছর যৌতুকের কারনে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে গড়ে ৬০০টি।শতকরা ১৪ ভাগ নারী মৃত্যু বরণ করছে গর্ভকালীন নির্যাতনের কারনে।

আমাদের দেশে শতকরা ৬০ ভাগের বেশি পুরুষ এখনও মনে করেন, স্ত্রীকে নির্যাতন করা বৈধ। হয়তো এখান থেকে পুরুষ শাসিত শব্দটি আরও বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকে সমাজে। পুরুষ শাসিত সমাজ বলেই কী নারীর প্রতি এতটা অবিচার,সহিংসতা?সে কী মানুষ নয়? এসমস্ত দুঃশাসন কিংবা স্বৈরাচারী মনোভাবের ফলে নারীর প্রতি নীপিড়ন থেমে থাকছে না।

যেকোন মানুষের জন্যে পরিবারই তার একমাত্র ভরসা ও বিশ্বাসের স্থল। সেক্ষেত্রে একজন নারী যখন পরিবার থেকে পূর্ণ সমর্থন পান না কিংবা একেবারেই পান না তখন অসহায় নারীর আর কোনো পথ থাকে না।

দেখা গেলো পরিবারে একজন নারীর যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ বা সঞ্চয় নেই,অথবা তার বাবার বাড়ীর শক্ত সামর্থ্যবান সদস্য নেই তাকে সমর্থন দেবার ;সেক্ষেত্রে অসহায় নারী তার আশ্রয়স্থল কিংবা স্বামীর বাড়ী বা শ্বশুরবাড়ীতে একরকম জিম্মি হয়ে থাকেন।
সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব নিপীড়ন দিনের পর দিন মুখ বুজে সহ্য করেন।

যৌতুকের কারনেই হোক অথবা উপরে উল্লেখ্য কারন যে কারনেই হোক নারী শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।অকালে প্রাণ হারানোর মতো ঘটনাও ঘটছে, যার পুরো খবর গণমাধ্যমে সেভাবে আসছে না।আসলেও সেসবের সুরাহা শক্তিশালীভাবে নিস্পত্তি তো হয়ই না বরঞ্চ নারীর পরিবারকে অপশক্তির কাছে হুমকির সম্মুখীন হতে হয়।এসব কারনে দিনের পর দিন বিচার না পেয়ে, বাধ্য হয় নারীর পরিবার মামলা উঠিয়ে নিতে।অথবা অবস্থা বেগতিক দেখে নারীর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কৌশলে বিচার বর্হিভূতভাবেই মিটিয়ে ফেলেন।

শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মৌখিক নির্যাতনের হারও কম নয়।এক্ষেত্রে ৬৭ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হোন। প্রচন্ড মানসিক আঘাতজনিত কারনে নারী অসুস্থ হয়ে পড়েন।সেক্ষেত্রে নারী যখন তার আত্মসম্মান বোধ হারিয়ে ফেলার ভয় পান বা একেবারে হারিয়ে ফেলেন; কারো কাছে বলার মতোন অবস্থাও যখন থাকে না তখন আত্মহননের মতো জঘন্য পথে পা বাড়ান অসহায় নারী।

১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের নারীর প্রতি সহিংসতা বিলোপ সংক্রান্ত ঘোষণায় বলা হয়েছে,
” এমন কোনো কাজ যা নারীর দৈহিক,যৌন কিংবা মানসিক ক্ষতির কারন হয় কিংবা সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে নারীর স্বাধীনতাকে জোরপূর্বক হরণ করা হয় তাকে নারীর প্রতি সহিংসতা বলা হয়।’ কাজেই নারীর ওপর যেকোন ধরনের নির্যাতনের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সর্বস্তরের মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করা,নারীর ক্ষমতায়নকে মজবুত করা এবং নারীর অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক দিবস ধার্য করা হয়।

আসছে ২৫ নভেম্ভর “ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্যা এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস ‘ যা পৃথিবী ব্যাপী পালিত হয়ে থাকে।

উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্ভর ডোমেনিকান প্রজাতন্ত্রে স্বৈরাচারী শাসকের দেয়া নির্দেশক্রমে তিনজন নারী প্যাট্রিয়া,মারিয়া তেরেসা ও মিনাভা মিরাকেল নিহত হোন। এ ঘটনাটির প্রতিবাদে প্রথম, লাতিন আমেরিকায় নারী অধিকার সম্মেলনে প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে নারী নির্যাতন দূরীকরণ দিবস হিসেবে গ্রহন করা হয়।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় উক্ত দিবসকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা করা হয়।

নারী সহিংসতা রোধে বিভিন্ন ধরণের আইন,সনদ,আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে।বিভিন্ন সংগঠনও বেসরকারিভাবে কাজ করে যাচ্ছে।তা স্বত্ত্বেও কেন নারী নির্যাতন মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না?বন্ধ হচ্ছে না? অনেক আইনি সংস্থা বিনা খরচেও নারীকে সেবাদানের কথা বলেন কিন্তু তারপরও বিচারহীণতা সংস্কৃতি নারীশক্তিকে ম্লান করে দিচ্ছে।

প্রথমত নারী একজন মানুষ তার প্রতি নির্যাতন করা গুরুতর অপরাধ এই শিক্ষাটি পরিবার থেকেই জোরালোভাবে দিতে হবে।
সন্তান গর্ভধারণের পর পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে ভ্রূণের যত্ন নিতে মায়ের জন্য বিশেষ সুষম খাদ্যের জোগান দেয়া, মায়ের মন ভালো রাখার জন্য চেষ্টা করা, ভারি কাজ করতে না দেয়া, বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, দক্ষ দাই বা ডাক্তারের কাছে সন্তান প্রসব করানো, পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে সুষম খাদ্য, শিক্ষা, ভালো আচরণ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবার থেকেই নারীকে সম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।

ছেলে শিশুকে আচার ব্যবহার শেখানোর সময়ও বিশেষভাবে বোঝাতে হবে।কন্যা শিশুকে সচেতনতার উদ্দেশ্যে তাকে স্বনির্ভরভাবে গড়ে তুলতে হবে।একজন নারীও অন্য নারীর প্রতি অসদাচরণ হতে পারবেন না সে বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় জ্ঞান,মানবীয় দীক্ষা প্রদানের চর্চা করতে হবে।

পাঠ্যপুস্তকে মানুষের সাথে মানুষের আচার-ব্যবহার এর শিক্ষার পাশাপাশি নারীর প্রতি স্বাভাবিক সুন্দর আচরণ গুলো অনুশীলনের ব্যবস্থা করা যায়।

তদুপরি নারীর প্রতি সহিংস আচরন ঘটলে তা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।এসব কারনগুলোর জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং যত দ্রুত বিচার ব্যবস্থার আওতায় এনে নারী বান্ধব মূলক কর্মকান্ড জোরালো করতে হবে।
প্রয়োজনে তথ্য প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এপস তৈরী করা যেতে পারে।যাতে করে নারীর প্রতি যেকোন ধরনের নির্যাতন সংগঠিত হলে তাৎক্ষনিক সেবা পাওয়া যায়।

নারী কারো না কারো মা,কারো আদরের বোন, বাবা-মায়ের আদরের সন্তান।সেই নারী কারো ঘরে সেবাদানকারী, মমতাময়ী স্ত্রী।একজন উচ্চশিক্ষিত নারী কর্মী,গৃহিণী কিংবা গৃহকর্মী এসব বিষয় নিয়ে বৈষম্য ভেদ করে তাকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়।প্রত্যেক নারী স্বত্ত্বার স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে।পরিবারের যারা সদস্য বিশেষ করে পুরুষ যখন কর্তা হোন, তখন তাকে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ঝামেলা এড়ানোর জন্যে ন্যায়,অন্যায় মূল্যায়ন করা জরুরী।সেক্ষেত্রে নারীটি যদি নির্দোষ হয় তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করা, সুন্দরভাবে নিস্পত্তি করা ব্যক্তিত্ববান পুরুষের পরিচয়।হোক সেটি কর্মস্থলে কিংবা আপনগৃহে। মনে রাখতে হবে,নারীর উন্নয়ন ঘটলেই একটি জাতির উন্নয়ন ঘটা সম্ভব।

সবচেয়ে বড় কথা,শুধু নারী বলে নয় একজন মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকাংশে কমে যাবে।গৃহে সন্তানরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বেড়ে উঠবে,গড়ে উঠবে সুশৃঙখল পরিবেশ।

এসএইচ-৪০/০৭/২১ (হাসিনা সাঈদ মুক্তা, গৃহিণী ও লেখক। বিষয়টি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে পদ্মা নিউজের কোন সম্পৃক্ততা নেই)