রাজশাহীতে এক বছরে পুকুর বেড়েছে ৩ গুন

গত এক বছরে রাজশাহী জেলায় বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে প্রায় ৩ গুন। মাছের উৎপাদন বাড়ায় একে সাফল্য হিসেবে দেখছে মৎস দপ্তর।

তবে কৃষি দপ্তর বলছে, বাণিজ্যিক এসব পুকুর খনন হয়েছে অবাদি জমিতেই। অপপরিকল্পিত পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। পরিবেশের উপর বাড়ছে চাপ।

জেলা মৎস্য দপ্তর জানিয়েছে, ২০১৭ সালে জেলায় মোট জলাশয়ের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ২৯৪ হেক্টর। এর মধ্যে বাণিজ্যিক মাছের খামার ছিল ৩ হাজার ৪৬২ হেক্টর। ২০১৮ সালে বাণিজ্যিক খামার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩০৯ হেক্টর। এখন জেলায় বাণিজ্যিক মাছের খামার ৪৩ হাজার ১৯৬টি।

মৎস বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ২০০৯ সালে জেলায় মাছের উৎপাদন ছিল ৫২ হাজার ১৭১ টন। ২০১৮ সালে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৮৯৯ টনে। এ ক’বছরে উৎপাদন বেড়েছে ৫৫ শতাংশের উপরে। চাষের পরিধি বৃদ্ধিসহ মৎস বান্ধব নানান কর্মসূচি বাড়িয়েছে উৎপাদন। তবে মাছ চাষের জন্য কি পরিমাণ আবাদি জমি কমছে সেই তথ্য নেই মৎস দপ্তরে।

অন্যদিকে, রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে জেলায় মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। এক শতাংশও আবাদযোগ্য পতিত জমি নেই। ২০০৭-২০০৮ সালেও জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৯১ হাজার ৭৮০ হেক্টর।

২০১২-২০১৩ মেয়াদে তা গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৯০ হাজার ৮১০ হেক্টরে। এখন আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। এক দশকে আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৩ হাজার হেক্টরের উপরে। এর একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোতে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুকুর-দীঘি খনন করতে পূর্বানুমতি লাগে না। মুনাফালোভীরা সেই সুযোগটিই নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, মৎস্য খামারিরা সাধারণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জমি বছর মেয়াদি লিজ নিচ্ছেন কাউকে জমি বিক্রি করতে বাধ্যও করছেন। তাছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ না হওয়ায় চাষিরাও জমি লিজ অথবা বিক্রি করছেন। পুকুর খনন করে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা রাখছেন না খামারিরা। ফলে বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ।

কৃষকরা বলছেন, ফসলি জমি কেটে আসলে পুকুর হচ্ছে না, বরং ঘের হচ্ছে। মাত্র চার থেকে পাঁচ ফুট খনন করা হচ্ছে। কিন্তু পুকুর করতে হলে অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে খনন করতে হয়।

দীর্ঘদিন ধরে পুকুর খনন চলছে জেলার নয় উপজেলাতেই। মাঝে কিছু সময়ের জন্য পুকুর খনন বন্ধ থাকলেও আবারও চলতে শুরু করেছে প্রভাবশালীদের খননযন্ত্র। ফের পুকুর খনন শুরু হয়েছে জেলার পবা, মোহনপুর, গোদাগাড়ী, বাগমারা ও দুর্গাপুরে।

অবৈধ পুকুর খননের দায়ে রোববার দুর্গাপুর উপজেলার দেলুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলামকে শনিবার ৭ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরে রোববার আদালতের মাধ্যমে তিনি জামিনে মুক্তি পান।

সমর কুমার পাল জানান, অবৈধভাবে ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুর খননের অভিযোগে এর আগে তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু আইন অমান্য করে পুকুর খনন চালিয়ে যাচ্ছেন চেয়ারম্যান। গতকাল শনিবার বিকেলে উপজেলার তিওরকুড়ি বিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডবিধির ১৮৬০ সালের গণউপদ্রব সৃষ্টি আইনের এই দণ্ড দেয়া হয়েছে।

রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুল বারী ভুলু জানান, কয়েক বছরে তার ইউনিয়নের অর্ধেক আবাদি জমি পুকুরে চলে গেছে। যেটুকু জমি অবশিষ্ট ছিল নতুনভাবে তাতেও চলতে শুরু করেছে খননযন্ত্র। অপরিকল্পিত পুকুর খননে জলাবদ্ধতা বৃষ্টি হয়ে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালি বলেন, অধিকাংশ পুকুর খনন করা হয়েছে নিষ্কাশন নালা, এমনকি ব্রিজ-কালভার্টের মুখে। এতে হালকা বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

শুধু ফসল নষ্টই নয়, পুকুর খনন বেশি হওয়ায় গ্রামে গৃহপালিত প্রাণিও কমে যাচ্ছে। চারণভূমি সংকটে মানুষ গরু, মহিষ ও ছাগল প্রতিপালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। কৃষকরা জানান, এসব অঞ্চলের ধান ও পাট, পানের বরজ, মরিচ, শাকসবজির উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে কয়েক দফা যোগাযোগ করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্বে) জাহাঙ্গীর আলমের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জেলা মৎস দপ্তরের সহকারী পরিচালক শিরিন শিলা বলেন, এভাবে অপরিকল্পিত পুকুর খননে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ না করা হলেও তা মাছ চাষের লাভ থেকে কয়েক গুণ। গত কয়েক বছর ধরে এই প্রবণতা খুবই। তবে এ নিয়ে তাদের কিছু করার নেই।

তবে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এসএম আবদুল কাদের সংবাদিকদের বলেন, ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টি আইনিভাবে সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া আদালত যদি নির্ধারণ করে দেয়, তবেই ক্ষতিপূরণ আদায় সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, আইন অমান্য করে পুকুর খননকারীদের বিরুদ্ধে বিধি মেনেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনাসহ জেল-জরিমানা করা হচ্ছে দোষিদের।

বিএ-১১/২১-০১ (নিজস্ব প্রতিবেদক)