রাজশাহীর একটি আবাসিক হোটেলে তরুণ-তরুণীকে হত্যার তিন বছর পর ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। রোববার বিকালে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) রাজশাহীর উপ-পরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম রাজশাহীর মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের গ্রহণ শাখায় চাঞ্চল্যকর এই মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এসআই মহিদুল ইসলাম নিজেই বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
তবে রাজশাহী মহানগর জজ আদালতের পরিদর্শক আবুল হাশেম বলেছেন, অভিযোগপত্র তিনি এখনও হাতে পাননি। হাতে পাওয়ার পর তিনি এতে স্বাক্ষর করবেন। এরপর তা বিচারকের কাছে উপস্থাপন করা হবে। বিচারক সিদ্ধান্ত দেবেন, অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হলো কি না অথবা গ্রহণ করা হলে কোন আদালতে মামলাটির বিচার কাজ শুরু করা হবে। খুব শিঘ্রই এসব সিদ্ধান্ত হবে।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৮ মার্চ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নগরীর বোয়ালিয়া থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক সেলিম বাদশা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, হোটেল কক্ষে প্রেমিক মিজানুর রহমান তার প্রেমিকা সুমাইয়া নাসরিনকে ধর্ষণ করেন। এরপর তাকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেন। তবে আদালত সেই প্রতিবেদন গ্রহণ না করে মামলাটি নতুন করে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপরই এ হত্যাকাণ্ডের জট খোলে। ধরা পড়েন খুনিরা।
নিহত মিজানুর (২৪) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। আর সুমাইয়া (২৩) ছিলেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তিনি বগুড়া সদরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা পুলিশের এসআই আব্দুল করিমের মেয়ে। আর মিজানুরের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পাঠানপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম উমেদ আলী। তিনি একজন কৃষক। সুমাইয়া ও মিজানুরের মরদেহ উদ্ধারের পর সুমাইয়ার পুলিশ কর্মকর্তা বাবা আবদুল করিম বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর তিনি আদালতে নারাজি দিয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতেই আদালত তদন্তের জন্য মামলাটি পিবিআইতে দিয়েছিলেন।
এর আগে ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার এলাকার অভিজাত হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের ৩০৩ নম্বর কক্ষে ঠাণ্ডা মাথায় প্রেমিক জুটি মিজানুর ও সুমাইয়াকে হত্যা করা হয়। প্রেমের প্রতিশোধ নিতে তাদের খুন করা হয় পরিকল্পিতভাবেই। ক্রাইম পেট্রোল দেখে খুনের পর স্বাভাবিক থাকার কৌশল রপ্ত করেছিলেন খুনিরা। দেড় বছর ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে একটি ফোনকলের সূত্র ধরে পিবিআই তাদের একে একে গ্রেপ্তার করে। হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পর তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্রও দাখিল হলো।
অভিযুক্ত আসামিরা হলেন, রাবির ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ (২১), রাজশাহী কলেজের প্রাণীবিদ্যার চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বোরহান কবীর ওরফে উৎস (২২), একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আল-আমিন (২০), রাবিতে দ্বিতীয় মেয়াদে ভর্তি প্রার্থী আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০) এবং হোটেল নাইসের বয় নয়ন (৩২) ও বখতিয়ার (৩২)। এদের মধ্যে আহসান হাবিব, বোরহান ও নয়ন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
রনি তার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, মিজানুরের সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ছিল। আর রাহাতের সঙ্গে ছিল বন্ধুত্ব। রাহাতের সঙ্গে সুমাইয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে মিজানুরের সঙ্গে নতুন করে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। এ নিয়ে রাহাত প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এরই মধ্যে মিজানুরের সঙ্গে দেখা করতে সুমাইয়া রাজশাহী আসছিলেন। সে সময় মিজানুর ফোন করে রনির কাছে জানতে চান, শহরের কোন হোটেলে উঠলে ভালো হয়। রনি তাকে হোটেল নাইসে ওঠার পরামর্শ দেন। মিজানুর-সুমাইয়া ওই হোটেলে উঠলে পরিকল্পনা অনুযায়ী, দুই হোটেল বয়ের সহযোগিতায় তাদের কক্ষে প্রবেশ করেন রাহাত, রনি, আল-আমিন ও উৎস। এরপর প্রথমে মিজানুরের গলায় ওড়না পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর দুই হাত বাধা অবস্থায় তার মরদেহের গলায় ফাঁস লাগিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এরপর সুমাইয়াকে তারা চারজন ধর্ষণ করেন। এ ঘটনা ফাঁস করে দেয়ার ভয়ে বালিশচাপা দিয়ে সুমাইয়াকেও হত্যা করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন ওই কক্ষ পরিদর্শনে যাওয়া প্রথম পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, মিজানের মৃতদেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো থাকলেও তাঁর দুই হাত ওড়না দিয়ে বাঁধা ছিল। তাঁর প্যান্টটি কোমর থেকে ভাঁজের মতো করে নিচে নামানো ছিল। দেখেই মনে হচ্ছিল, কেউ একজন টান দিয়ে নামিয়েছে। তাছাড়া মিজানুরের গলার দুই পাশে দাগ ছিল। আত্মহত্যা করলে সেই দাগ একদিকে হওয়ার কথা। এসব চিহ্ন দেখে তখনই তাঁর মনে হয়েছিল এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাছাড়া হোটেল কক্ষে তিন ধরনের সিগারেটের ফিল্টার পাওয়া যায়। একই মানুষ তিন ধরনের সিগারেট খেতে পারে না। দায়িত্ব পাওয়ার পর ‘ক্লু লেস’ একটি ঘটনার তদন্ত তিনি এভাবেই এগিয়ে নিয়ে যান।
এসআই মহিদুল জানান, দুই হোটেল বয়কে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে হাত করেছিলেন মামলার বাকি চার আসামি। তাই সুমাইয়া ও মিজানুর যাওয়ার পর পরিচ্ছন্নতার কাজের নামে কক্ষে প্রবেশ করে এসি রাখার স্থান ভেতর থেকে ফাঁকা করে দিয়েছিলেন দুই হোটেল বয়। এরপর ওই চারজন দেয়ালের ফাঁকা স্থান দিয়েই কক্ষে প্রবেশ করেন। তখন মিজানুর কক্ষে ছিলেন না। তারা সুমাইয়াকে দিয়ে ফোন করিয়ে মিজানুরকে কক্ষে ডেকে আনেন। এরপর চারজন মিলে খুব সহজেই প্রতিবন্ধী শারীরিক মিজানুরকে হত্যা করেন। ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে হত্যার পর মিজানুরের ফেসবুক আইডি থেকে আত্মহত্যার একটি পোস্টও দেয়া হয়। দুজনকে হত্যার পর তারা দেয়ালের এসি রাখার ফাঁকা স্থান দিয়েই বেরিয়ে যান। আর কক্ষের দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ থাকে।
তিনি জানান, একটি ফোনকলের সূত্র ধরে প্রথমে রনিকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজশাহীর দুটি ছাত্রাবাস থেকে বাকি তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাদের তথ্যমতে দুই হোটেল বয়কে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের মধ্যে হোটেল বয় বখতিয়ার ছাড়া বাকি সবাই উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন। সংশ্লিষ্টদের গভীর জিজ্ঞাসাবাদ, পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই ও নির্ভুলভাবে অভিযোগপত্র তৈরির জন্য দাখিলে একটু সময় লাগলো।
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, মামলা একটি হলেও অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে দুটি। মূল অভিযোগপত্র ধরা হয়েছে সুমাইয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা। এর সঙ্গে আরেকটি অভিযোগপত্র যুক্ত করা হয়েছে মিজানুরকে হত্যার। দুটি অভিযোগপত্রেই ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে দুই হোটেল বয়ের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যা কিংবা ধর্ষণের অভিযোগ নেই। এসব অপরাধে সহায়তার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।
বিএ-১৪/২৭-০৪ (নিজস্ব প্রতিবেদক)