রাজশাহীতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিক্ষার্থীরা, শিক্ষাবিদদের উদ্বেগ

রাজশাহীবাসীর কাছে বিনোদনের অন্যতম স্থান পদ্মার পাড়। প্রতিদিন বিকেলে নগরীর শহররক্ষা বাঁধের ১২ কিলোমিটারজুড়ে ভিড় করেন বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষ। অবসর সময় কাটান, নিশ্বাস নেন মুক্ত বাতাসে। এই পদ্মারপাড় ঘিরে একটি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অবাধ ঘোরাফেরার চিত্র উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। নগরীর পদ্মা গার্ডেন, মুক্ত মঞ্চ, সীমান্ত অবকাশ, সীমান্ত নোঙ্গর, লালন শাহ পার্ক, টি-বাঁধসহ বিভিন্ন বিনোদন স্পটগুলোতে তাদেরকে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। এদের বেশিরভাগই উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ে।

ক্লাসে না গিয়ে ওইসব স্পটে শিক্ষার্থীরা আড্ডায় মগ্ন হচ্ছে। প্রকাশ্যে ধূমপান ছাড়াও জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন আপত্তিকর ঘটনায়। যা দেখে উদ্বিগ্ন হচ্ছে সাধারন মানুষ। বেশ কিছুদিন থেকে পর্যবেক্ষণ করা দেখা গেছে, এদের বেশিরভাগই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর শিক্ষার্থী। আর এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

স্কুল ও কলেজ চলাকালীন সময়ে ইউনিফর্ম পরেই ঘুরছে তারা। মেতে উঠছে অবাঞ্চিত আড্ডায়। আবার কেউ কেউ ইউনিফর্ম খুলে ব্যাগে রেখে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে পদ্মার পাড় এলাকায়। বন্ধু বা বান্ধবীকে নিয়ে একান্ত সময় কাটানোর পর বাসা-বাড়ি ও মেসে ফিরে যাচ্ছে তারা। এতে অভিভাবকগণ কোনভাবেই বুঝতে পারছে না তাদের সন্তান স্কুল কিংবা কলেজ ফাঁকি দিচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের এই অবাধ মেলামেশায় সামাজিক অবক্ষয় বাড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। পাশাপাশি এমন পরিস্থিতির জন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের দায়ী করছেন বিভিন্ন মহল। এমনকি প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। এ অবস্থা নিরসনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর পদ্মা গার্ডেন, মুক্ত মঞ্চ, সীমান্ত অবকাশ, সীমান্ত নোঙ্গর, লালন শাহ পার্ক, টি-বাঁধে ক্লাস চলাকালে ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীদের অবাধ মেলামেশার চিত্র। পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে এসে এসব দৃশ্য দেখে লজ্জায় পড়ছেন অনেকেই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের বাঁধা দিচ্ছে না। এমনকি অনেক রেস্টুরেন্ট এই আপত্তিকর মেলামেশার সুযোগ করে দি”েছ বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মঙ্গলবার দুপুরে ক্লাস চলাকালীন সময়ে পদ্মাপাড়ে দেখা মেলে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র ও শাহ্ মখদুম কলেজের এক ছাত্রীকে। চোখে পড়ে ওই শিক্ষার্থীদের অবাধ মেলামেশার চিত্র। জানা যায়, তাদের দুজনেরই বাড়ি নওগাঁয়। পড়ালেখার সুবাদে তারা রাজশাহীতেই থাকে।

শুধু ওই দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নয়, দেখা গেছে মহিলা কলেজের ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন ছাত্রীকেও। এছাড়াও মসজিদ মিশন একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজ, সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের আড্ডা দিতে দেখা গেছে।

পদ্মা গার্ডেন, মুক্ত মঞ্চ, সীমান্ত নোঙ্গর, লালন শাহ পার্ক, টি বাঁধে ঘুরে একাধিক ব্যক্তি জানান, সকালের দিকটায় যখন স্কুল-কলেজ খোলা থাকে তখন এ জায়গাগুলোতে ইউনিফর্ম ও ইউনিফর্ম না পরা উঠতি বয়সের অসংখ্য ছেলে-মেয়ে ঘোরাফেরা করে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধু-বান্ধবীকে নিয়ে একান্ত সময় কাটাতে নিরাপদ স্থান হিসেবে তারা এই স্থানগুলো বেছে নেয়। অনেক সময় তাদেরকে অশালিন অবস্থায়ও দেখা যায় বলে জানান এসকল এলাকায় বসবাসকারী ও দোকানীরা।

আবুল কালাম নামে এক ব্যক্তি জানান, অভিভাবকদের নিয়মিত খোঁজ রাখা, পার্ক-উদ্যানে স্কুল-কলেজ চলাকালীন সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়লে এসব স্থানে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা কমে আসবে।

নাটোর থেকে আসা রাজশাহী সরকারী সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয়। সে জানায়, শহরে নতুন এসেছি, তাই কলেজের ফাঁকে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে আসলাম।

এ বিষয়ে সচেতন মহল মনে করেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের খোঁজ-খবর নেয়া। সন্তানরা প্রতিদিন স্কুল-কলেজে যাচ্ছে কিনা? বা সবগুলো ক্লাসে অংশ নিচ্ছে কিনা, তা প্রতিদিন খোঁজ নেয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

কোন শিক্ষার্থী যেন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসব স্থানে আড্ডা না দিতে পারে, সেজন্য কাজ করে যাচ্ছেন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। মঙ্গলবার সকালে পদ্মার পাড়ে দেখা গেছে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে আসা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরকে ধরে ধরে বোঝাচ্ছেন রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ। ক্লাস ফাঁকি দেওয়া ঐসব শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফেরার শপথ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেন তিনি।

এসময় তাঁর সাথে ছিলেন রাজশাহী কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক বারিক মৃধা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক রুবাইয়াত-ই-আফরোজ, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজের প্রভাষক মোস্তাফিজুর রহমান। ক্লাস চলাকালে বিনোদন ও ভ্রমনের স্থানগুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান।

এ বিষয়ে কথা হয় অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান সাথে। তিনি বলেন, প্রত্যেক অভিভাবককে খোঁজ রাখতে হবে, তাদের ছেলে বা মেয়েটা স্কুল-কলেজে গেল কিনা? এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে শিক্ষার্থীদের উপর নজরদারীর জন্য শিক্ষকদের দায়িত্ব দিতে হবে। প্রতি ১৫ জন শিক্ষার্থীর দেখভালের জন্য ১ জন শিক্ষককে গাইড হিসেবে রাখা যেতে পারে। নিযুক্ত শিক্ষক ঐসব শিক্ষার্থীর খোঁজ রাখবেন। এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানরা ঐসকল শিক্ষকদের কাছে তাদের সম্পর্কে জানতে পারবেন।

তিনি আরো বলেন, সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অনুপস্থি হলে বিভিন্ন ক্লাসে গিয়ে নোটিস করতে হবে। পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের কিছু করণীয় আছে বলে আমি মনে করি। যেমন প্রশাসন মাইকিং করতে পারে, কোন শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজ ইউনিফর্ম পরে অথবা না পরে ক্লাস চলাকালীন সময়ে ঐসব স্থানে অবস্থান করতে পারবে না। করলে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তাহলে এ অবস্থা কিছুটা কমতে পারে বলে জানান তিনি।

শিক্ষার্থীদের পদ্মাপাড়ে ঘুরতে প্রসঙ্গে এই শিক্ষাবিদ বলেন, তাদের নৈতিকার অবক্ষয় হচ্ছে, পড়ালেখায় গুরুত্ব দিচ্ছে না, এতে সামাজিক অবক্ষয়ের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। লেখাপড়ার মূলস্রোত থেকে তারা দুরে সরে যাচ্ছে। যার ফলে মাদকাসক্ত হচ্ছে। এমনকি তারা সন্ত্রাসের পথও বেছে নিতে পারে। আমি মনে, করি এক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনকেও তাঁদের দায়িত্ব নিতে হবে।

এ বিষয়ে সচেতন মহলের দাবি, প্রশাসনের তদারকিতে যে করেই হোক স্কুল-কলেজের ক্লাস চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীরা যেন পার্কে গিয়ে বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করতে না পারে, লেখাপড়া বাদ দিয়ে যেন বাজে পথে না যেতে পারে সে বিষয়ে গুরুত্বসহকারে সকললে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও নিতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, রাজশাহী শহররক্ষা বাঁধের ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়েই শিক্ষার্থীদের এমন চলাফেরা নজরে পড়ে। অনৈতিক কার্যকলাপের সাথে সাথে বিভিন্ন সময় মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের সখ্যতা গড়ে উঠছে। ফলে তারা ধূমপান ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা বিভিন্নসময় মহানগর পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করেছি। তারা বিভিন্নসময় পুলিশের টহল বাড়িয়েছে, কিন্তু এ সমস্যার কোন স্থানীয় সমাধান হয়নি। বিষয়টি সমাধানে শিক্ষক, অভিভাবক, পুলিশ-প্রশাসন সকলকে এগিয়ে আসতে হবে মন্তব্য করেন তিনি।

বিএ-২০/০৯-০৭ (নিজস্ব প্রতিবেদক)