কৃষিতে মজুরি বৈষম্যের শিকার আদিবাসী নারী শ্রমিকরা

‘সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত আট ঘণ্টা কাজ করি। মজুরি পাই মাত্র দুই’শ টাকা। অথচ একই সময় পুরুষ শ্রমিকেরা কাজ করে পান সাড়ে তিন’শ থেকে চার শত টাকা। আমরা নারী বলে আমাদের মজুরি কম। কাজ পাই না, তাই পুরুষের অর্ধেক মজুরি নিতে হয়।’ আক্ষেপের এই কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের চৌদুয়ার গ্রামের কৃষিশ্রমিক পদ্মাবতী (৪৫)।

কথা হয় আরেক আদিবাসী নারী শ্রমিক মামনী খালকুর সাথে। দুই মেয়ে, এক ছেলে ও শশুড়সহ মোট ছয়জনের সংসার তাঁর। তিনি বলেন, ছয়জনের অভাবী সংসার এক স্বামীর পক্ষে চালনো সম্ভব নয়। তাই তিনি সংসারের হাল ধরতে স্বামীর সাঙ্গে অল্প মুজুরিতে পরের জমিতে কাজ করেন। তাদের মতো উপজেলার কয়েক শ নারী শ্রমিক মজুরিবৈষম্যের শিকার হলেও, তাঁদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই।

বিভিন্ন খাতে এগিয়ে গেলেও কৃষি ক্ষেত্রে এখনও চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নারীরা। এ ধরনের মজুরিবৈষম্য নিরসনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় হতাশ এই নারী শ্রমিকেরা।

জানা গেছে, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর নারী দিবসে সভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে কেবল সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করে। নারীদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সংস্থার সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এমনকি উপজেলায় কত সংখ্যক নারী শ্রমিক নিয়োজিত আছেন, তারও কোনো জরিপ নেই মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কাছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মো: মতিয়র রহমান জানান, চলতি বছর উপজেলায় ২৪ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষ হয়েছে। তবে এবছর রোপা-আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ২৩ হাজার ৭৪৬ হেক্টর।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চাষাবাদের কাজে নিয়োজিত অধিকাংশই শ্রমিকই নারী। মজুরি কম বলে চাষিরা নারী শ্রমিকদেরই বেশি নিয়োজিত করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদিরপুর ও সোনাদীঘি এলাকার কয়েকজন চাষি বলেন, ‘ধানসহ অন্যান্য খেতে পুরুষ শ্রমিকেরা মজুরি পান সাড়ে তিন শ থেকে চার শ টাকা। আর নারী শ্রমিকদের দিই দু শ টাকা।’

নারী শ্রমিকের মজুরি কেন পুরুষ শ্রমিকের অর্ধেক এমন প্রশ্নে শ্রী মংলা সরদার নামের এক শ্রমিক বলেন বলেন, জমির মালিকরা মনে করেন নারীদের চেয়ে পুরুষরা শক্তিশালী। কম সময়ে বেশি কাজ করতে পারবে। তাই নারীদের তুলনায় পুরুষের মজুরি বেশি।

এ প্রসঙ্গে চৌদুয়ার গ্রামের প্রধান শ্রী জহুরলাল পান্না বলেন, অনেক আগ থেকেই এই মজুরিবৈষম্য চলে আসছে। তিনি মনে করেন বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে মাঠপর্যায়ে কাজ করা উচিত। সেই নারী শ্রমিকদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শারমিন শাপলা বলেন, ‘পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের মজুরি অর্ধেক হওয়া সত্যি দুঃখজনক। তবে এই বৈষম্য নিরসনে সচেতনতামূলক সভা ও মানববন্ধন করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। দুঃখের বিষয় উপজেলায় কত সংখ্যক নারী শ্রমিক রয়েছেন বা কাজ করেন তার তথ্যও নেই মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কাছে।’

উল্লেখ্য, দেশে সেবা, শিল্প ও কৃষি অর্থনীতির এই তিন বৃহত্তর খাতে এক কোটি ৬৮ লাখ নারী সম্পৃক্ত। শুধু কৃষি খাতেই নিয়োজিত রয়েছেন ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী। ২০১০ সালে এখানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৬৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। একই সঙ্গে পারিবারিক খাতে নারীরা ৮০ ভাগেরও বেশি শ্রম দিচ্ছেন, যারা কোনো মজুরি পান না।

বিএ-১২/০৫-১০ (বাবর মাহমুদ)