রাজশাহীতে হত্যা মামলার হয়রানী থেকে বাঁচতে গ্রামবাসীর সংবাদ সম্মেলন

রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাচন্দুর গ্রামের পুকুর পাহারাদার হত্যা মামলার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিচার দাবি ও অজ্ঞাতনামা মামলার হয়রানী থেকে পরিত্রাণ পেতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন গ্রামের অর্ধ-শতাধিক সাধারণ মানুষ। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

জানা গেছে, গত ১লা সেপ্টেম্বর রোববার দিবাগত রাতে উপজেলার কচুয়া গ্রামের মঠপুকুরিয়া মাঠে অবস্থিত একটি পুকুরে খুন হন পাচন্দুর গ্রামের রইসউদ্দিন উনু (৬৫)। সেই খুনের মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামীর তালিকায় নাম উঠেছে পাঁচন্দুর গ্রামের উত্তর পাড়ারসাধারণ মানুষের। আর এ নিয়ে ওই এলাকার মানুষের মনে চলছে পুলিশি গ্রেপ্তার আতঙ্ক। এ আতঙ্কে পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষগুলো প্রায় ২ মাস ধরে ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।তাই এমন হয়রানীর প্রতিকারের জন্যই বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন তারা।

সংবাদ সম্মেলনে গ্রামবাসী জানান, একাধিক নিরাপরাধ ব্যক্তিকে বিভিন্ন সময় থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ারও ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার পুলিশের এ অজ্ঞাতনামা মামলার শিকার হয়ে পুলিশ কর্তৃক আটক হন পাঁচন্দর উত্তর পাড়া গ্রামের মৃত শরিয়তুল্লাহ মন্ডলের ছেলে রবিউল ইসলাম ও লতিফুর রহমানের ছেলে আনারুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার আদালতে তার রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। কিন্তু আদালত আবেদন মঞ্জুর করেন নি।

এই হত্যাকান্ড নিয়ে গ্রামীবাসীর মনে বিভিন্ন প্রশ্ন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। গ্রামবাসীর অভিযোগ, চলতি বছরের ১৭ আগস্ট পাঁচন্দর উত্তর পাড়া ঈদগাহ মাঠের জমি দখলকে কেন্দ্র করে একই গ্রামের আবু বকর সিদ্দীক ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে গ্রামবাসীর বিবাদ হয়। ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঈদগাহ পরিচালনা পর্ষদের ১৭ জনের বিরুদ্ধে তানোর থানায় চুরি ও ছিনতাইয়ের মামল দায়ের করেন তারা। ওই মামলার সকল আসামী জামিনে মুক্তি পান। এরপরে গ্রামবাসীও তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন।

এ ঘটনার পরে পহেলা সেপ্টেম্বর মঠপুকুরিয়া মাঠের পুকুরের পাহারাদার রইসউদ্দিন উনুর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। নিহতের ভাই আইননুদ্দিন, নইমুদ্দিন, ভাতিজাশামমোহম্মদ প্রমূখ বাদি হয়ে থানায় মামলা করেন। নিহত ব্যক্তি রইসউদ্দিন উনু আবু বাক্কার সিদ্দিকের আপন ফুফাত ভাই। পূর্ব শত্রুতার জেরে এই সুযোগ নিয়ে সিদ্দিক উনু হত্যা মামলায়গ্রামের মানুষদের নাম জড়ানোর জন্য ফুফাত ভাই অর্থাৎ নিহতের ভাই নইমুদ্দিন নয়মকে মোটা অঙ্কের টাকা প্রদান করে বলে অভিযোগ করেন গ্রামবাসী।

হত্যা মামলায় অজ্ঞাত আসামী হিসেবে গ্রেফতারকৃতদেরকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এছাড়াও ঐ গ্রামের আইনাল নামের এক ব্যক্তি মিথ্যা হত্যা মামলার গ্রেফতার আতঙ্গে কয়েকদিন আগে স্ট্রোক করে মৃতুবরণ করেছেন।

গ্রামবাসী এই হত্যাকান্ড ও তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, এ হত্যাকান্ডের তদন্তপ্রশ্নবিদ্ধ। এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যেমন- আইনুদ্দিন (মৃত ব্যক্তির ভাই) ও শামমোহম্মদ (মৃত ব্যক্তির ভাতিজা) হত্যাকান্ডের দিন মৃতদেহের কাছে গিয়ে কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই চিৎকার ও গালাগালিজ করতে থাকেন যে, ঈদগাহের পক্ষে সমাজের যারা রয়েছে তারাই রইসউদ্দিন উনুকে হত্যা করেছে। কোনকিছু তথ্য প্রমাণ ছাড়ায়, কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই কি উদ্দেশ্যে তারা এই ধরনের মন্তব্য করল যার সঠিক তদন্ত আজও হয়নি বলে জানান গ্রামবাসী।

মামলার অন্যতম বাদী নিহতের ভাই নইমুদ্দীনের ছেলে জাকির হোসেন নিয়মিত পুকুরপাড়ে চাচার সাথে রাতে থাকতেন। কিন্তু হত্যাকান্ডের ঘটনার রাতে নইমুদ্দীন তার ছেলেকে চাচার কাছে পুকুরে যেতে দেন নি। সেই পুকুরপাড়ে স্যান্ডেল, মাছমারা বড় জাল পাওয়া গেছে এবং যে টিনের ঘরে রইসউদ্দিন উনু থাকতেন সেই ঘরের টিনে রক্ত লেগেছিল যা হত্যাকারীর রক্ত বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু এগুলোর সঠিক তদন্ত হয়নি।

হত্যাকাণ্ড যে পুকুরপাড়ে হয়েছিল, রাতের বেলা বাদীরা সেখানে নিয়মিত মাদকের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। তবে কে বা কারা তাকে হত্যা করলোআর এই সকল বাদী মাদকব্যবসায়ী কারোরই চোখে পড়ল না সেই বিষয়টিও তদন্তের দাবী করেন গ্রামের ভূক্তভোগী সাধারণ মানুষ।

তারা বলেন, ৫জন মাদক ব্যবসায়ীর একজন হলেন সাবেক ১ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ওমর আলী।ওরফে‘বাপকাটা’ ওমর বলে এলাকার মানুষ জানে। নিজ পিতাকে কোদালের কোপে হত্যা করার কারনে তার এই নাম হয়। পরবর্তীতে কিভাবে যেন আইনের চোখে ধুলা দিয়ে সে এই হত্যা মামলা হতে রক্ষা পায়। এই ব্যক্তির বেশ সখ্যতা দেখা যায় আবু বাক্কার সিদ্দিক, রাসেলও নইমদ্দিনের সাথে। এটাও তদন্তের মধ্যে আসা উচিত বলে জানান সংবাদ সম্মেলনকারীরা।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে আরো উল্লেখ করা হয়, পাড়ার মহিলাদের মাঝে ও লোকমুখে শোনা যা”েছ, রইসউদ্দিন উনু নিহত হওয়ার পর তার পরিবারকে পুকুরের বর্তমান লিজ মালিক তরিকুল মাষ্টার কোন একদিন ৭০হাজার টাকা দিয়েছেন। যাতে করে পুলিশের কাছে তারা একথা না বলে যে, উনু পাহারাকাজে নিয়োজিত হওয়ার ৫দিনের মাথায় কাজ ছেড়ে দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল।

আবার ঘটনার কয়েকদিন পর মুন্ডুমালা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ কর্মকতা জামালউদ্দিনের উপস্থিতিতে ঐ পুকুরে জাল দ্বারা মাছ ধরা হয়। পরবর্তীতে তরিকুল মাষ্টার নিজে মুন্ডুমালা বাজারে বলে বেড়ান যে, একবস্তা মাছ তানোর থানার পুলিশের জন্য, আরেক বস্তা মাছ মুন্ডুমালা ফাঁড়ির পুলিশের জন্য পাঠালাম।

গ্রামবাসীরা জানান, মামলার ১নম্বর বাদী নইমদ্দিন মামলা রূজ্জুর পরের দিন স্ব-শরীরে তানোর থানায় উপস্থিত হয়ে বলেন, আমার মামলার বাদী হওয়ার ইচ্ছা ছিলনা। অন্যের প্ররোচনায় আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। বিধায় মামলার বাদী হতে বাধ্য হয়েছি। মামলার বাদী হতে আমি আমার নাম প্রত্যাহার করতে চাই। এবং পাড়ার লোকজনকে আমার কোনভাবেই সন্দেহ হয়না।

তারও একদিন পর ভিকটিমের একমাত্র ছেলে আলফাজ, ভাই আইনুদ্দিন, আরেক ভাই আয়েশ উদ্দিন কুশু, জামাতা রাব্বানী ভায়ের ছেলে শাহাম্মদ তানোর থানায় উপস্থিত হয়ে বলেন, এজাহারে উল্লিখিত ১২ জনের নাম উল্লেখ করা আমাদের ঠিক হয়নি। রাতের আঁধারে কে বা কারা ভিকটিমকে মেরে ফেলেছে তা আমাদের অজানা। গ্রামের নিরীহ লোকজনকে আমার পিতার হত্যাকারী হিসেবে আমাদের কোনভাবেই সন্দেহ হয় না।

তাহলে কি আবু বাক্কার সিদ্দিক ও নইমুদ্দীন (নয়ম) গ্রামের সাধারণ লোকজন ও ঈদগাহ কমিটির সদস্যদেরকে ফাঁসানোর জন্যই এই পরিকল্পিত হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছিল এমন প্রশ্ন রেখেছেন গ্রামের সাধারণ মানুষরা।

সংবাদ সম্মেলনের একদিন পূর্বে, এ ব্যাপারে তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খাইরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়েছে এবং পুলিশের যৌথ টিম তাদের জিজ্ঞাসা করছে। এর পূর্বেও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং ছেড়েও দেয়া হয়েছে। সাধারন মানুষদের হয়রানি করার কথাটি তিনি অস্বীকার করেন।

বিএ-১২/০৭-১১ (নিজস্ব প্রতিবেদক)