রাজশাহীতে বেপরোয়া ছাত্রলীগ নেতা নাঈমের ক্যাডার বাহিনী

রাজশাহীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইমুল হাসান নাঈম এবং তার ক্যাডার বাহিনী। নাঈমের ক্ষমতার দাপট এবং আস্ফালনে সবাই থাকেন তটস্থ।

মাদক ব্যবসা, কোচিং সেন্টার থেকে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা চাঁদাবাজি, মুক্তিপণের দাবিতে টর্চার সেলে নির্যাতন, কলেজ হোস্টেল নিয়ন্ত্রণ করে সিট বাণিজ্য এবং কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করাসহ অসংখ্য অপরাধ সংঘটিত হলেও কেউই নাঈমের ভয়ে মুখ খোলেন না।

আর নাঈমের নির্দেশে সব অপকর্ম সম্পাদন করে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রাসিক দত্ত, সহযোগী প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রোজেল, সাংগঠনিক সম্পাদক মানিক মাহাবুব রতনসহ ২০-২৫ জন ক্যাডার। নাঈমের অপকর্ম বাস্তবায়নে কাজ করে তারা। এ সব ছাত্রলীগ নেতার পরিচয় ছাত্র হলেও বই-কলমের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। নাঈম, রাসিক, রতন, রোজেলসহ এ বাহিনীর অনেকেই আছেন- যারা কেউই নিজেরা পরীক্ষায় বসেন না। কখনও জোরপূর্বক, কখনও বা ব্লাকমেইল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাদের হয়ে পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করেন।

সম্প্রতি রাজশাহী মহিলা কলেজ কেন্দ্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈমের ক্যাডার রতন মাহাবুব মানিককে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বুধবার দুপুরে সংবাদ মাধ্যমকে বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর সাবরীনা শাহনাজ চৌধুরী।

অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান রাজিবের চাচাত ভাই নাঈম। এ কারণে নাঈম এবং তার বাহিনী লাগামহীন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

এ ছাড়া রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের এক তরুণ নেতার আশীর্বাদও রয়েছে নাঈমের প্রতি। ফলে নাঈম এবং তার বাহিনীর নির্যাতন এবং চাঁদাবাজিতে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলও দেখার কেউ নেই।

তবে সর্বশেষ বুধবার দুপুরে ইউনি কেয়ার নামে একটি কোচিং সেন্টারের পরিচালক রায়হান হোসেনের দায়ের করা চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন নাঈম।

ছাত্রলীগ নেতা নাঈম দীর্ঘদিন থেকে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বাড়ি নগরীর রাজারহাতা এলাকায়। এলাকাটি রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ সংলগ্ন। সিটি কলেজ এবং এর পার্শ্ববর্তী লোকনাথ স্কুলের আশপাশে নাঈম তার বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে। মূলত এ এলাকায় ইয়াবার ব্যবসা চলে।

গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকলেও রহস্যজনক কারণে এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। রাজশাহী মহানগরীর অধিকাংশ কোচিং সেন্টারগুলো নাঈমের বাড়ি রাজারহাতার পার্শ্ববর্তী এলাকায়।

সিটি কলেজ, লোকনাথ স্কুল, সোনাদীঘি এবং পার্শ্ববর্তী কাদিরগঞ্জ এলাকায় কোচিং সেন্টার রয়েছে দেড় শতাধিক। এ সব কোচিং সেন্টারের মালিকদের জিম্মি করে রেখেছে নাঈম এবং তার বাহিনীর সদস্যরা।

কোচিং সেন্টারের মালিকরা নাঈমকে মাসোহারা না দিলে কোচিং সেন্টার চালাতে পারেন না। প্রতিমাসে নাঈম এ সব কোচিং সেন্টার থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় বলে জানিয়েছে কোচিং সেন্টারের মালিকরা।

নাঈম ছাত্রলীগ রাজশাহী কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক হলেও পার্শ্ববর্তী সিটি কলেজের ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে তার টর্চার সেল। ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি আমজাদ হোসেন নামে এক যুবককে এ টর্চার সেলে ধরে নিয়ে যায় নাঈমের অনুসারীরা। এরপর তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। বাড়িতে ফোন দিয়ে দাবি করা হয় চাঁদা।

আমজাদ জেলার মোহনপুর উপজেলার গোছাবাজার গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে। রাজশাহী মহানগরীতে তিনি নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের ব্যবসা করেন।

আমজাদ গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, সে সময় নাঈমের টর্চার সেলে আমাকে লাঠি ও লোহার পাইপ দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে আমার পরিবারের সদস্যদের ফোন দিয়ে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন নাঈম। প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে ৩০ হাজার এবং পরে আমাকে ছেড়ে দেয়ার সময় বাকি টাকা দেয়া হয়।

এদিকে এ ঘটনার পর আমজাদের স্ত্রী জেসমিন খাতুন পুলিশে অভিযোগ করেন। এরপর আমজাদের মোবাইল ফোন নম্বর ট্রেস করে তার অবস্থান নিশ্চিত হয় পুলিশ। বিষয়টি বুঝতে পেরে নাঈম আমজাদকে মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় সোহাগ নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করে পুলিশ। তবে ঘটনার মূল নায়ক নাঈম হলেও সে থেকে যায় ধরাছোয়ার বাইরে।

অভিযোগ রয়েছে, নাঈমের টর্চার সেলে এখনও নির্যাতনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজে মোট তিনটি হোস্টেলের সাতটি ব্লকে প্রতিবছর আসন ফাঁকা হয়। এই ফাঁকা আসনগুলোয় শিক্ষার্থী উঠানোর জন্য কলেজ ছাত্রলীগের সুপারিশ নিতে হয়। সেই সুযোগে ছাত্রলীগ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে থাকে। এই চাঁদা আদায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন নাঈম।

চাঁদা দিতে বাধ্য হওয়া এক শিক্ষার্থী জানান, নাঈমকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে হোস্টেলে উঠেছি। আবার মাঝেমধ্যেই নাঈমের নাম করে দু-একজন এসে চাঁদা নিয়ে যায়।

রাজশাহী কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী বলছেন, ছাত্রলীগ নেতা নাঈমের কথা মতো কাজ না করলেই ধরে ধরে পেটানো হয়। চাঁদা না দিলে বা মিটিং-মিছিলে অংশ না নিলে বা শিবির আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করা হয়।

২০১৬ সালের ১৭ মার্চ রাতে কলেজের মুসলিম হোস্টেলের নিউ ব্লকে ঢুকে নাঈমের সঙ্গে করমর্দন না করার কারণে তিন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন নাঈম ও তার বাহিনী। এর মধ্যে মামুন নামের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী পঙ্গু হয়ে যায়। এছাড়া ছাত্রলীগের মিছিলে শ্লোগান দিতে দেরি হওয়ায় ফিরোজ নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে ধরে পেটান নাঈম।

রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজশাহী কলেজের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যেই নানা সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছেন ছাত্রলীগের নাঈম। তার দাপটে যেন সবাই অস্থির। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে সে যা ইচ্ছে তাই করছে। অথচ দেখার কেউ নেই।

অপরদিকে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করে নাঈম বাহিনীর সদস্য রাসিক দত্ত ও রতনসহ অন্তত ১০ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এ হামলায় আহত হন রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল্লাহ মিম, পদ্মা নিউজের সাব এডিটর বাবর মাহমুদ এবং বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ডট কমের প্রতিবেদক মোফাজ্জ্বল বিদ্যুৎ।

এছাড়া রাজশাহী কলেজ প্রশাসন ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস ঘোষণা করলেও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখা যায় নাঈম এবং রাসিকসহ তার বাহিনীর সদস্যদের।

ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ রাজিবের চাচাতো ভাই নাঈম। এ কারণে সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পান না। রাজিবের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া নাঈমের গুরু হিসেবে সব ধরনের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ভাগ্নে।

তবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে নাঈমকে বহিষ্কার করা হয়। এর কিছুদিন পরই তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়। কিন্তু এরপরও থামেনি দলের নামে নাঈমের অপকর্ম।

নাঈম এবং তার বাহিনীর সদস্যদের অপকর্মের ব্যাপারে রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাজশাহী কলেজ মহানগর ছাত্রলীগের আওতাভুক্ত ইউনিট। নাঈমসহ ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ উঠেছে সে ব্যাপারে মহানগর ছাত্রলীগ নেতারা সিদ্ধান্ত নেবেন।

নাঈমকে সমর্থন দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান রাজিব বলেন, নাঈম আমার আপন চাচাত ভাই হলেও তাকে সব সময় শাসন করার চেষ্টা করেছি। নাঈম হয়ত দুই একটা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। নিজের যোগ্যতাতেই নাঈম রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। সামনে মহানগর ছাত্রলীগের সম্মেলন। এ সম্মেলনে নাঈমও পদপ্রতাশী। এ কারণে একটি মহল নাঈমের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে দাবি করেন এ ছাত্রলীগ নেতা।

তবে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রকি কুমার ঘোষ বলেন, আমি সাংগঠনিক কাজে ঢাকায় অবস্থান করছি। নাঈমকে গ্রেফতারের কথা শুনেছি। চাঁদাবাজি ও ভাঙচুরের ঘটনায় তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে ফের তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিএ-০৫/২৭-০২ (নিজস্ব প্রতিবেদক)