শেষের পথে রমযানের রহমতের দিনগুলো

শেষ হওয়ার পথে পবিত্র রমযানের রহমতের দিনগুলো। আজ আট রমযান। আর দু‘দিনের মধ্যে রহমতের রোযাগুলো শেষ হবে। রমযান মাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য সেহরী খাওয়া। রোযা রাখার জন্য শেষ রাতে ফজরের পূর্বক্ষণে কিছু খাওয়াই হলো সেহরী। ইফতার করার মধ্যে যেমনি বরকত ও সওয়াব রয়েছে, তেমনি সেহরীর মধ্যেও বরকত ও সওয়াব রয়েছে। এ বিষয়ে মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে রাসূলে মকবুল (সাঃ) বলেছেন, সেহরী খাওয়ায় নিশ্চয়ই বরকত রয়েছে। অপর হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী করীম (সাঃ) তাগিদ করে বলেছেন “যে লোক রোজা রাখতে চায় তার কোন কিছু খেয়ে সেহরী পালন করা কর্তব্য।” অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- মুসলমানদের এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের রোজা রাখার মধ্যে পার্থক্য হলো সেহরী খাওয়া। অর্থাৎ মুসলমানরা সেহরী খেয়ে রোযা থাকে আর অমুসলিমরা সেহরী না খেয়ে রোযা থাকে। এই পার্থক্য সুস্পষ্ট।

সেহরী খাওয়া বিলম্বিত করার জন্য হাদীসে তাকিদ এসেছে। সেহরী দেরী করে গ্রহণ করাকে কল্যাণের প্রতীক বলা হয়েছে। হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ)-এর থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “আমার উম্মত যতদিন পর্যন্ত ইফতার ত্বরানি¦ত করবে এবং সেহরী বিলম্বিত করবে, ততদিন তারা কল্যাণময় হয়ে থাকবে।”

সেহরী খাওয়ার শেষ সময় হলো সুবহে সাদিক উদয় হওয়া। এ শেষ সময় পর্যন্ত সেহরী খাওয়া বিলম্বিত করাই সুন্নাত। তিনি সেহরী খাবার জন্য যেমন তাগিদ দিয়েছেন তেমনি ইহা বিলম্বিত করে শেষ মুহূর্তে খাবার জন্যও উৎসাহ প্রদান করেছেন। সুবহে সাদিক উদয় হবার বহু পূর্বে প্রায় মধ্য রাতে সেহরী খাওয়া ইসলামে পছন্দনীয় কাজ নয়। এতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর সন্তুষ্টি নিহিত নেই। এতে রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীদের অনুসৃত ও আচরিত রীতি অনুসরণ হয় না। রাসূল (সাঃ) তাগিদ করেছেন, “তাছাহহারু ফি আমেরীল লাইলে” অর্থাৎ তোমরা রাত্রির শেষ দিকে সেহরী গ্রহণ করো।

মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা আল বাকারার ১৮৭নং আয়াতে রাতের অন্ধকারকে কাল রেখা এবং ভোরের আলোকে সাদা রেখার সাথে তুলনা করে রোজা শুরু এবং খানাপিনা হারাম হওয়ার সঠিক সময়টি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সুবহে সাদেকের উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পানাহার বন্ধ করা যেমন জায়েজ নয়, তেমনি সুবহে সাদেক হওয়ার পর খানাপিনা করাও হারাম। মুসনাদে আহমাদে হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) হতে একটি চমৎকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে নামায ও রোজা পালনের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন, নবী করীম (সাঃ) এভাবে এ নিয়মে নামায পড়েছেন। আর তিনি বলেছেন, তোমরা রোজা রাখ। যখন সূর্য অস্তমিত হয় তখনই তোমরা খাও, পান করো যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার সামনে সাদা সুতা কালো সুতা হতে স্পষ্টরূপে পৃথক হয়ে না যায়। আর রোজা থাক ত্রিশ দিন তবে এর পূর্বে যদি তুমি চাঁদ দেখতে পাও তা হলে তখন রোজা ভঙ্গ করবে। একথা শুনে আমি সাদা ও কালো দুইটি সূতা সম্মুখে রেখে এর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখলাম। কিন্তু এতে আমার নিকট কিছুই স্পষ্ট হলো না। পরে একথা রাসূলে করীম (সাঃ)-এর নিকট পেশ করলাম।

তিনি শুনে হেসে উঠলেন এবং বললেন, এই হাতীমের পুত্র, তুমি যা বুঝেছ তা নয়, আসলে উহা রাতের অন্ধকার কালো হতে দিনের শ্বেত ঔজ্জ্বল্য প্রকাশিত হওয়া মাত্র। মূলত ইবনে হাতীম (রাঃ)-এর ইহা বুঝবার ভুল ছিল। মানুষের তৈরি সাদা সুতা, কাল সুতা উদ্দেশ্য নয়। হাদীস ও আয়াতের উদ্দেশ্য হলো- প্রভাতের আলো ও রাত্রির অন্ধকার অর্থাৎ রাতের অন্ধকার কাল হতে দিনের শ্বেত শুভ্র আলো যতক্ষণ না স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে ততক্ষণ খাওয়া দাওয়া চলতে পারবে। আর যখনই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে-তখনই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করতে হবে এবং রোজা রাখা শুরু করতে হবে।

হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সেহরি খাও, কেননা সেহরিতে বরকত রয়েছে। (বুখারী শরীফ, হাদিস ১৮০১ ও মুসলিম শরীফ, ১০৯৫/৪৫) অন্য এক হাদিসে আছে, সেহরি খাওয়া বরকতপূর্ণ কাজ। সুতরাং তোমরা তা ছেড়ে দেবে না, যদিও এক ঢোক পানি দিয়ে হোক না কেন। কারণ যারা সেহরি খায় আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং তার ফেরেস্তাগণ তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস-১০৭০২)

হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাদের (মুসলমানদের) রোজা আর আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিষ্টান) দের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সেহরি খাওয়া আর না খাওয়া। (মুসলিম শরীফ, পৃষ্ঠা ১৩১)

হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সেহরি খাও, যদি তা এক ঢোক পানিও হয়। অন্যত্র বলেছেন, তোমরা সেহরি খাও, যদি এক লোকমা খাদ্যও হয়। এই হাদিসসমূহ দ্বারা সেহরির গুরুত্ব বোঝা যায়। এক ঢোক পানি, এক লোকমা খাদ্য, এক কাপ দুধ, সামান্য ফলমূল বা একটি খেঁজুরের মতো সামান্য হলেও সেহরি গ্রহণ করা সুন্নত। সেহরি একদিকে শারীরিক শক্তি জোগায়, যা রোজা পালনে সহায়ক হয়, অপর দিকে রুহানি শক্তি জোগায়, যা তাকওয়া অর্জনে সহয়তা করে। বরকতময় সেহরির কল্যাণকর নানা দিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- সুন্নতের অনুসরণ করা, ইসলামের নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষা করা, ইবাদতের জন্য শক্তি এবং তাকওয়া অর্জন, স্বাস্থ্য ও মনের অধিক প্রফুল্লতা লাভ, ক্ষুধার তাড়নায় সৃষ্ট প্রবৃত্তির বাসনা নিবারণ।

এমনকি সেহরির সময় দোয়া কবুল হয়। এসময় অধিক জিকির-আজকার, তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া মোনাজাতের সুযোগ লাভ হয়। কোনো কারণে সেহরি খাওয়া সম্ভব না হলেও রোজা রাখতে হবে, কোনো প্রকার বাহানায় রোজা ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়। এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সেহরি বর্জন করা ঠিক নয় এটা সুন্নতের বরখেলাপ। তা ছাড়া নবীজী বলেছেন, সেহরি ছাড়া রোজা রাখা ইহুদি নাসারাদের ধর্ম। তাই সেহরি গ্রহণ করে ইসলামি রোজার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা করা ইমানদারদের কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কবুল করুন।

এসএইচ-০১/১৪/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)