শেষের পথে মাগফিরাতের দশক

শেষের পথে মাগফিরাতের দশক। একে একে ফুরিয়ে যাচ্ছে মাহে রমযানের বরকতময় দিনগুলো। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হওয়ায় এর মধ্যে দৈহিক ও আর্থিক ইবাদাতের সমন্বয় রয়েছে। নামায-রোযা দৈহিক ইবাদত, যাকাত অর্থনৈতিক ইবাদত এবং হজ্ব দৈহিক ও অর্থনৈতিক সমন¦য় ইবাদত। সূরা মুজ্জাম্মেলের ২০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর, আল্লাহ তা’আলাকে (তার নির্দেশিত পথে) উত্তম ঋণ দাও, আর তোমরা নিজেদের কল্যাণে যা অগ্রে প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ প্রতিদান হিসেবে (পরকালে) প্রাপ্ত হবে।”

রোযা যেমন দেহের পরিশুদ্ধতাকারী, যাকাত তেমন অর্জিত ধন-সম্পদের পবিত্রতাকারী। মহান রাব্বুল আলামীন সূরা আত-তাওবার ১০৩ নং আয়াতে মহানবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে ধনীদের সম্পদ হতে যাকাত গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, “হে নবী, তাদের ধন-মাল হতে যাকাত গ্রহণ করো। এর সাহায্যে তুমি সেগুলোকে এবং তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ কর।” যাকাত না দিলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

তাতেও যাকাত পরিশোধে অস্বীকার করলে মুরতাদ হয়ে যাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ বৈধ হবে। হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেছেন, যে লোক যাকাত দেয়ার দায়িত্ব হতে মুর্তাদ-অস্বীকৃত হবে, আল্লাহর শপথ, আমি তার বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করবো। বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু বকর (রাঃ) এর ভাষা ছিল এরকম : যে লোক নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, আল্লাহর শপথ, আমি তার বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করবো।

যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ বর্ধিত হওয়া, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করা। আর ব্যাপক অর্থে যাকাত বলতে বুঝায়, শরীয়তের বিধান অনুযায়ী নেসাব পরিমাণ সম্পদের এক বছরান্তে আল কুরআনে বর্ণিত খাতে নিদিষ্ট পরিমাণ অংশ প্রদান করা। ঠিক কখন যাকাত ফরয হয়েছে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। মুহাদ্দিস ইবনে খুযায়মা দাবি করে বলেছেন, “হিজ্বরতের পূর্বে যাকাত ফরয হয়েছিল। কারো মতে হিজ্বরী দ্বিতীয় সনে রোযা ফরয হবার পূর্বে। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেছেন, হিজ্বরী নবম বছরে। আবার অনেকের মতে, সপ্তম হিজ্বরীতে ফরয হয়। আল্লামা ইবনে আসীর লিখেছেন, যাকাত ফরয হবার হুকুম মক্কা শরীফে নাযিল হয়েছে। তবে নিয়ম ও বিধি, কোন জিনিসে কতটুকু ও কিভাবে যাকাত দিতে হবে তার বিস্তারিত বিধি বিধান মদীনায় নাযিল হয়েছে।

আল কুরআনের সূরা আল বাকারার ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন “আর নামায কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর।” সূরা আর রুমের ৩৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির নিমিত্তে যে সুদ ভিত্তিক লেনদেন করে থাক, প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহর নিকট কোন লাভজনক লেনদেন নয়। পক্ষান্তরে তোমরা যে যাকাত প্রদান কর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তা বৃদ্ধি পায়, ফলত যাকাত প্রদানকারীগণ মুনাফাকে দ্বিগুণ করে নেয়।” যাকাত ফরয হবার মেয়াদ সম্পর্কে তিরমিযী ও বায়হাকীতে বর্ণিত হয়েছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে লোক কোন ধন-সম্পদ লাভ করল, আর এর মালিকের নিকট পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হবার পূর্বে তার উপর যাকাত ফরয হবে না।”

যাকাত কারা পাবে বা যাকাতের মালের হকদার কারা বা যাকাতের সম্পদের বিতরণের খাতসমূহ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা আত তাওবার ৬০ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা হলো ফকীর, দরিদ্র, মিসকীন, যাকাত আদায়ে নিযুক্ত ব্যক্তি, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য নওমুসলিমকে, ক্রীতদাস বা গোলাম মুক্তি, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরকে যাকাতের অর্থ প্রদান করতে হবে।

সূরা মায়ারিজের ২৪-২৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন; ‘আর যাদের ধন সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিতদের জন্য নির্দিষ্ট অধিকার।’

এই পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামায এবং রোজার সম্পর্ক মানুষের দৈহিক পরিশ্রম ও মনের সাথে সম্পৃক্ত, পক্ষান্তরে যাকাত ও হজ্বের সম্পর্ক অর্থের সাথেও রয়েছে। বিশেষভাবে যাকাত ধনী বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ওপরই ফরয হয়ে থাকে। হাদীস শরীফে আছে, রাসূল সা. ইরশাদ করেন- ‘তাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে গ্রহণ করা হবে। আর তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র বা অভাবী তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।’ (বুখারী ১৪০১)

ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য করে জাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। হাদীসের ভা-ারে সংরক্ষিত হয়েছে যাকাতের বিশেষ গুরুত্ব সংবলিত অনেক হাদীস।

জারির ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘আমরা রাসূল সা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করি নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনার ওপর। (বুখারী, মুসলিম)

আবু সায়ীদ রা. বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসূল সা. আমাদেরকে নসিহত করছিলেন। তিন বার শপথ করে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, রমযানের রোযা রাখবে, যাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য অবশ্যই বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ কর’।’ (নাসায়ী: ২৩৯৫)

যারা যাকাত আদায় করে না তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির সংবাদ এসেছে। আল্লহ তা’আলা ইরশাদ করেন- আল্লাহ যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তারপরও তারা কার্পণ্য করে, তারা যেন এই কৃপণতাকে নিজেদের জন্য ভালো মনে না করে। না, এটা তাদের জন্য অত্যন্ত খারাপ। কৃপণতা করে তারা যাকিছু জমাচ্ছে তাই কিয়ামতের দিন তাদের গলার বেড়ি হবে। পৃথিবী ও আকাশের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। আর তোমরা যা কিছু করছো, আল্লাহ তা সবই জানেন। (সূরা আলে ইমরান: ১৮০)

অন্যত্র ইরশাদ করেন- যারা সোনা রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুখবর দাও। একদিন আসবে যখন এ সোনা ও রূপাকে জাহান্নামের আগুণে উত্তপ্ত করা হবে, অতঃপর তারই সাহায্যে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে দাগ দেয়া হবে- এ সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। নাও, এখন তোমাদের জমা করা সম্পদের স্বাদ গ্রহণ কর। (সূরা আত তাওবা: ৩৪-৩৫)

যাকাত গরিবের প্রতি কোন করুণা নয় বরং তার হক- যা ধনী ব্যক্তিকে অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ কারণে আবু বকর রা. বলেছেন, ‘যারা রাসুল সা. এর যুগে একটি উটের রশিও জাকাত হিসেবে আদায় করত আর এখন তারা যদি জাকাত দিতে অস্বীকার করে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।’ (বুখারী: ১৩১২) তার এ ভাষণের মর্মার্থই ছিল, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা যাতে কেউ কাউকে তার অধিকার হতে বঞ্চিত করতে না পারে।

যাদের ওপর যাকাত ওয়াজিব: ১. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে।

২. যাদের সম্পদের ওপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবে ফসলের ক্ষেত্রে এক বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরি নয় বরং ফসলের যাকাতের সম্পর্ক ফসল পাকার সাথে।

৩.ফলের যাকাত ওয়াজিব হয় যখন তা পরিপক্কতা লাভ করে এবং খাওয়ার উপযোগী হয়।

* যাকাত ওই সব লোকের ওপর ওয়াজিব হয় যাদের নিকট সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৮৫ গ্রাম) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৫৯৫ গ্রাম) রৌপ্য অথবা তৎসমান অর্থ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক বছর যাবৎ রিজার্ভ বা জমা আছে।

যাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ

আল্লাহ তা’আলা কুরআন পাকে যাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ উল্লেখ করে দিয়েছেন। কুরআনে জাকাতের অর্থ ব্যয়ের জন্য ৮টি খাত উল্লিখিত হয়েছে।

ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী. কৃতদাসকে মুক্তকরার জন্য, মুআল্লাফাতে কুলুব তথা অমুসলিমদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, ঋণগ্রস্ত, ফি সাবিলিল্লাহ খাত তথা যারা আল্লাহর পথে বিভিন্নভাবে জিহাদরত, মুসাফিরদের জন্যও যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।

এসএইচ-০১/২৪/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)