গোণাহ মাফ করাতে পারলো না, সে হতভাগা

রমযানের আজ উনিশতম দিন। মাগফিরাতের দিনগুলোও প্রায় শেষ। যে ব্যক্তি পবিত্র রমযান পেল কিন্তু তার জীবনের গোণাহ মাফ করাতে পারলো না, সে হতভাগা। হাদীসে এসেছে জিব্রাইল (আঃ) একদিন বলছিলেন, যে ব্যক্তি রমযান পেলো তবু গোনাহ মাফ করাতে পারলো না, সে ধ্বংস হোক। রাসুল (সাঃ) জিব্রাইল (আঃ)-এর দোয়ার প্রেক্ষিতে আমিন বলেছেন। সুতরাং রমযান মাসেই আমাদের সকল গোণাহ মাফ করানোর জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে।

লাইলাতুল কদরের ফযিলত লাভের প্রত্যাশায় লাখো কোটি মানুষ সদা তৎপর থাকবে। আর এ রজনীর সন্ধানে বিশতম রমযান থেকে অনেকে ইতিক্বাফে বসবেন। পবিত্র রমযানে জীবনকে সংশোধিত করতে অনেক কাজ করার সুযোগ হয় পবিত্র রমযানে। তাই অনেকে অধিক সওয়াবের আশায় এ মাসেই যাকাত আদায় করে থাকে। যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। পাঁচ ধরনের সম্পদকে যাকাতের নিসাবের মধ্যে গণ্য করা হয়।

সাড়ে সাত তোলা পরিমাণ সোনা (৮৫ গ্রাম) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৫৯৪ গ্রাম) পরিমাণ রূপা থাকলে অথবা সমপরিমাণ নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা অথবা ব্যবসার কাজে এক বছর অতিক্রম করলে ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে। গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে প্রথম ৩০টির জন্য ১ বছর বয়সী ১টি বাছুর দিতে হবে। এর ঊর্ধ্বের হার ভিন্ন ভিন্ন। ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে প্রথম ৪০টির জন্য ১টা এবং পরবর্তী ১২০টির জন্য ২ টা ছাগল/ভেড়া যাকাত দিতে হবে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উট ও ঘোড়া পালন করলে তারও যাকাত আদায় করতে হবে। কৃষি উৎপন্ন পণ্যসামগ্রীর উপর ওশর ফরয হবে।

মিল ফ্যাক্টরির দালান-কোঠা ও মেশিনের উপর যাকাত নেই। মিল-ফ্যাক্টরির মওজুদ কাঁচামাল ও উৎপন্ন দ্রব্যের যাকাত দিতে হবে। কোম্পানির শেয়ার, ব্যবসার মাল ও সোনা-রূপা মিলিয়ে নিসাব পরিমাণ অর্থ হলে যাকাত দিতে হবে। বছর শেষে ব্যবসার মূলধন ও লাভ মিলিয়ে মোট টাকার উপর যাকাত দিতে হবে। যৌথ মালিকানাধীন মিল-ফ্যাক্টরির প্রত্যেক শেয়ারের মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, প্রত্যেককে আলাদাভাবে যাকাত দিতে হবে।

কারো নিকট নিসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদ আমানত রাখলে যিনি আমানত রাখলেন, তাকেই যাকাত দিতে হবে। কেউ কাউকে নিসাব পরিমাণ ঋণ দিলে ঋণদাতাই যাকাত দেবেন, ঋণগ্রহীতা নয়। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা উঠানোর পর যাকাত দিতে হবে। পেছনের বছরগুলোর যাকাত দিতে হবে না। অলংকারের মধ্যে পাথর থাকলে সেই পাথরের যাকাত নেই। খাদ অলংকারের ওজনের মধ্যে শামিল। খাদসহ ওজন করে মূল্য নির্ধারণ করে যাকাত দিতে হবে। অলংকার বিক্রয় করতে গেলে যেই টাকায় বিক্রয় করা যাবে সেই টাকার হিসেবে যাকাত দিতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন, সেলাই মেশিন, ওয়াশিং মেশিন, মোটর সাইকেল, গাড়ি, আসবাবপত্র ও কাপড়-চোপড়ের ওপর যাকাত নেই।

যেই মাসে নিসাব পূর্ণ হবে পরবর্তী বছর সেই মাসে যাকাত ফরয হবে। অলংকারের মালিক যদি স্ত্রী হন তাহলে তাকেই যাকাত দিতে হবে। স্বামী যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে যাকাত দেন তাহলে স্ত্রীর যাকাত আদায় হয়ে যাবে। যাকাত আদায়ের জন্য নিযুক্ত কর্মচারীর বেতন যাকাতের অর্থ থেকে দেয়া যাবে। অন্য কোন ব্যক্তিকে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাত দেয়া যাবে না। যাকাত আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অন্যতম ইবাদত। ইনকাম ট্যাক্স সরকার কর্তৃক ধার্যকৃত একটি ট্যাক্স। ইনকাম ট্যাক্স দিলে যাকাত আদায় হবে না। পৃথকভাবে যাকাত দিতে হবে। কাউকে যাকাতের টাকা দেয়ার সময় একথা বলার প্রয়োজন নেই যে, এইগুলো যাকাতের টাকা। উপহার উপঢৌকন রূপেও তা দেয়া যাবে। দেয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করলেই যাকাত আদায় হবে।

যাকাত ফরজ হওয়ার পেছনে অসংখ্য হিকমত রয়েছে। যেমন, সম্পদ উপার্জনের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে অনেক তারতম্য রয়েছে। আর এ তারতম্য কমিয়ে ধনী-গরিবের মাঝে ভারসাম্য আনার জন্য মহান আল্লাহ যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ দেখা যায় কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, অর্থ-কড়ি ও ভোগ-বিলাসে মত্ত আছে এবং প্রার্চুর্যের চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করছে আর কিছু লোক দারিদ্র সীমার একেবারে নিচে অবস্থান করছে। মানবেতর জীবন যাপন করছে। আল্লাহ এ ব্যবধান দূর করার জন্যই তাদের সম্পত্তিতে যাকাত ফরজ করেছেন। যাতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমে যায় এবং ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর হয়। অন্যথায় দেশে বা সমাজে হিংসা- বিদ্বেষ, ফিতনা-ফাসাদ ও হত্যা-লুণ্ঠন ছড়িয়ে পড়বে। বিঘিœত হবে সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতি।

এছাড়া যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো, যাকাত মানুষকে কৃপণতা থেকে বিরত রাখে। মানুষকে পরোপকারী, অন্যের ব্যথায় সমব্যথী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হতে সাহায্য করে। অধিকাংশ দেশেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় যাকাত দারিদ্র্যবিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সহায়তা করে দারিদ্র দূর করতে।

যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুমলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ভাবমর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে এবং আত্মমার্যাদা ও সম্মানবোধ বৃদ্ধি পায়। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। তাদের মাঝে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যরে সেতুবন্ধন রচিত হয়। দূর হয় পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ। কারণ গরিবরা যখন ধনীদের সম্পদ দ্বারা উপকৃত হয় এবং তাদের সহানুভূতি লাভ করে, তখন তাদের সহযোগিতা করে এবং তাদের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট হয়। যাকাত আদায় করলে আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদ এবং ধন-সম্পদের বরকত বাড়িয়ে দেন। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল ইরশাদ করেন, ‘সদকা করার কারণে কখনো সম্পদ কমে না।’ দান-খয়রাত করলে সম্পদের পরিমাণ কমলেও সম্পদের বরকত কমে না।

যাকাত একটি সমাজ বা দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও গতিশীলতাকে স্বাভাবিক রাখার নিশ্চয়তা বিধান করে। যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থাই বর্তমান অর্থব্যবস্থার সব প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নানাবিধ সমস্যার যুৎসই সমাধান।
যাকাত নামক এ ইবাদতে মালি বা অর্থনৈতিক ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর অনুগ্রহ ও রহমতকে ত্বরান্বিত করে। কুরআনে করিমে ইরশাদ হয়েছে, যাকাত আদায় করা আল্লাহর সাহায্য লাভের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। (সূরা আ‘রাফ: ১৫৬)

যারা যাকাত আদায় করে না তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির সংবাদ এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- আল্লাহ যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তারপরও তারা কার্পণ্য করে, তারা যেন এই কৃপণতাকে নিজেদের জন্য ভালো মনে না করে। না, এটা তাদের জন্য অত্যন্ত খারাপ। কৃপণতা করে তারা যা কিছু জমাচ্ছে তাই কিয়ামতের দিন তাদের গলার বেড় হবে। পৃথিবী ও আকাশের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। আর তোমরা যা কিছু করছো, আল্লাহ তা সবই জানেন। (সূরা আলে ইমরান: ১৮০)

অন্যত্র ইরশাদ করেন- যারা সোনা রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুখবর দাও। একদিন আসবে যখন এ সোনা ও রূপাকে জাহান্নামের আগুণে উত্তপ্ত করা হবে, অতঃপর তারই সাহায্যে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে দাগ দেয়া হবে- এ সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। নাও, এখন তোমাদের জমা করা সম্পদের স্বাদ গ্রহণ কর। (সূরা আত তাওবা: ৩৪-৩৫)

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই চোখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলতে থাকবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’ (বুখারী)

এসএইচ-০১/২৫/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)