সকল ধর্মেই রোজা বা উপবাস থাকার বিধান রয়েছে

সকল ধর্মেই রোজা রাখা বা উপবাস থাকার বিধান রয়েছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে অন্যান্য ধর্মের ন্যায় সূর্যের সময় হিসাবে রোজার সময় নির্দিষ্ট করা হয়নি। চাঁদের সময়ের হিসাবে রোজার তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। যাতে মানুষ সহজে সারা বছর পরিবর্তিত সময়ে রোজা রাখতে পারে। সৌর মাস অনুযায়ী রোজা রাখার নির্দেশ হলে কোন কোন অঞ্চলে দিন বড় হবার কারণে মানুষের জন্য রোজা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর হতো। আবার কোন কোন অঞ্চলের মানুষ দিন ছোট হবার কারণে সহজেই রোজা রাখতে পারতো। চন্দ্র মাসের হিসাবে রোজা রাখার দরুন এই অসাম্যের কোনো অবকাশ নেই।

হযরত হাফেজ আবদুল কায়্যিম (রঃ) বলেছেন যে, রোজার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় ফরজ করা হয়নি। বরং মাধ্যমিক অবস্থায় ফরজ করা হয়েছে। কেননা সাহাবায়ে কেরাম ততদিনে তাওহীদ ও সালাত ইত্যাদি ইবাদত পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেছিলেন। (যাদুন মাআদ)

রোজার মাধ্যমে মানুষ নিজের নাফসের বাড়াবাড়িকে সুনিয়ন্ত্রণ করতে শিখে। তাই সহীহ হাদীসে উল্লেখ আছে, “প্রত্যেক জিনিসের যাকাত আছে তার দেহের যাকাত হলো রোজা।” মানুষের স্বভাবে দুই ধরনের শক্তি নিহিত আছে। একটি হলো ফেরেশতাসুলভ শক্তি আর অপরটি হলো পশুসুলভ শক্তি। ফেরেশতাসুলভ শক্তি মানুষকে আল্লাহর মারিফাত অর্জনে সহায়তা করে। আর পশুসুলভ শক্তি আল্লাহর পরিচিতি লাভে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাকওয়া বা খোদাভীতি রূহানী শক্তিকে প্রবল করে।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের অন্তরই হলো তাকওয়ার স্থান। আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, “ফা আলহামাহা ফুযূরাহা ওয়া তাকওয়াহা”- অর্থাৎ তিনি তাকে তার দুষ্কর্ম ও তার সংযমশীলতা অবগত করিয়েছেন। যাবতীয় ইবাদত ও নেক আমল তাকওয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় আর যাবতীয় পাপাচার ফুযুরের আওতাধীন। এ দু’টি পরস্পর বিরোধী শক্তি আদিকাল থেকে মানুষের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “শোন, দেহের মধ্যে একটি মাংসের টুকরা রয়েছে, যতক্ষণ ওটা ভালো থাকবে, সমস্ত দেহ ততক্ষণ ভালো থাকবে। আর যখন সেটা খারাপ হয়ে যাবে তখন সারা দেহই খারাপ হয়ে যাবে। জেনে রাখ সেটা হলো কালব বা হৃদপিন্ড।” অন্য হাদীসে তিনি সাহাবায়ে কেরামদের (রাঃ) লক্ষ্য করে বলেন, “তোমরা জেনে রাখ তাকওয়ার স্থান এইখানে, অতঃপর তিনি দিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন।”

রোজার মাধ্যমে একজন মুসলিম লেবাসী মুসলমান না হয়ে সর্বক্ষেত্রে তাকওয়ার পাবন্দি হতে হবে। একজন মুত্তাকী মুসলিমের ঈমানিয়াত বা বিশ্বাস সম্পর্কিয় বিষয়সমূহ, ইবাদত বা উপাসনা সম্পর্কিত বিষয়াদি, মুআমিলাত বা সাংসারিক সম্পর্কীয় বিষয়াদি, মুআশরাত বা সামাজিক ব্যবহার সম্পর্কিত বিষয়াদি। তামাদ্দুন বা কৃষ্টি সভ্যতা, ইকতেসাদিয়াত বা অর্থনীতি সম্পর্কীয় বিষয়াদি এবং সিয়াসিয়াত বা রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়াদি ইসলামের আদর্শে বাস্তবায়িত ও প্রতিফলিত করা অপরিহার্য। এটাই হলো মানব সমাজের জন্য তাকওয়ার দাবি।

যারা আল্লাহর বিধান পালন করতে গিয়ে রোজা রাখবে, তারাই হবে তাকওয়াবান। এছাড়াও কুরআন-হাদিসে রোজা পালনের অনেক উপকারিতা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু রোজা কীভাবে মানুষকে তাকওয়াবান করে তুলবে? মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় তৈরি করবে? অথচ আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে রোজার বিধান ঘোষণায় এ তাকওয়া অর্জনের কথা বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রমযানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেভাবে তোমাদের আগের লোকদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল। আশা করা যায়, তোমরা আল্লাহভীতি বা পরহেজগারী অর্জন করতে পারবে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)
যারা রোজা রাখবে তাদের ব্যাপারে এ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আশা করা যায়, তোমরা তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় অর্জন করতে পারবে।

রমযানের নির্দেশনা হলো- দিনের বেলায় হালাল বস্তু পানাহার, বৈধ স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা থেকে বিরত থাকার মাধ্যম রোজা পালন করা। কেউ যদি আল্লাহর শাস্তির ভয়ে দিনের বেলা উল্লেখিত হালাল কাজগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে তাহলে নিঃসন্দেহে সে আল্লাহর ভয় অর্জন করতে পারবে।

যারা আল্লাহর নির্দেশে হালাল কাজ থেকে নিজেদের বিরত থাকতে পারে, নিঃসন্দেহে তারা দুনিয়ার সব হারাম কাজ থেকেও বিরত থাকতে পারবে। মানুষের পেটে যখন ক্ষুধা লাগে তখন দেহের অনেক অঙ্গেই তা আন্দোলিত কিংবা পরিলক্ষিত হয়। যখনই কেউ ক্ষুধা নিবারনে খাবার খায়, তখন তার সেসব অঙ্গ স্বস্তি ও চাঙা হয়ে যায়।

রোজা মানুষকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে হিফাজত করে, যৌন উত্তেজনাকে প্রশমিত করে। রোজা রাখার ফলে মানুষের যখন ক্ষুধা লাগে তখন মানুষ গরিব-দুঃখির না খাওয়ার কষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়। তাদের প্রতি রোজাদারের হৃদয় ও মন আকৃষ্ট হয়। তাদের ক্ষুধার কষ্ট লাগবে রোজাদারের দান-খয়রাত করার মানসিকতা তৈরি হয়।

কষ্টের সম্মুখীন হওয়া ছাড়া মুখে শুনে কিংবা বই পড়ে কোনো মানুষই কষ্টের পরিপূর্ণ বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারে না। যখন মানুষ কষ্টের সম্মুখীন হয় তখনই কেবল বাস্তব কষ্ট কেমন তা বুঝতে সক্ষম হয়। যেমনিভাবে গাড়িতে চড়া ব্যক্তি পায়ে হাটা ব্যক্তির কষ্ট কখনো অনুধাবন করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে সমান দূরত্ব পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি না দেয়।
সুতরাং আল্লাহর নির্দেশে রমযানের উপবাস থাকার মাধ্যমে রোজা পালন করলেই মানুষ প্রকৃত কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে।

আর তাতে রোজা প্রকৃত শিক্ষাও মানুষের সামনে ফুটে ওঠে। মানুষ হয়ে ওঠে পরহেজগার বা তাকওয়াবান। রোজা মানুষকে নিয়ম-শৃঙ্খলা শিক্ষা দেয়। আল্লাহর নির্দেশ পালনের মানসিকতা তৈরি করে দেয়। নফসের দাসত্ব ও পাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। যারা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, তারা দুনিয়ার ধনি-গরিব সব মানুষের প্রতি সদয় থাকে।

রমযানের রোজা দুনিয়ার সব মুসলমানকে এক কাতারে সামিল করে দেয়। ধনি-গরিব কিংবা আমির-ফকিরে কোনো বৈষম্য থাকে না। কেননা ইফতার-সাহরি গ্রহণে কেউই সময়ের ব্যবধান করতে পারে না।

রমযান অন্য সময়ের তুলনায় মানুষকে মসজিদের দিকে বেশি ধাবিত করে। মন্দ কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। আল্লাহর নির্দেশ পালনে একনিষ্ঠ হয়। আর এভাবেই মানুষ মন্দ কাজ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর ভয় অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়। আল্লাহ তাআলা মানুষকে রমযানের রোজা পালনের মাধ্যমে কুরআনের ঘোষণা তাকওয়া অর্জন করার তাওফিক দান করুন।

এসএইচ-০১/২৮/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)