বিড়িশিল্প সমৃদ্ধ রংপুরের হারাগাছ এলাকায় বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহার হচ্ছে নকল ব্যান্ডরোল। আর এসব নকল ব্যান্ডরোল জমিয়ে দোকানিকে দিলে পাওয়া যায় টাকা। প্রায় ১০০ ব্যান্ডরোল ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় কিনে নিয়ে যান খোদ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। পরে এসব নতুন প্যাকেটের রাজস্ব পরিশোধের স্টিকার হিসেবে বাজারে ছাড়া হয় নতুন প্যাকেট।
সরেজমিনে বিড়ির রাজধানী হিসেবে পরিচিত রংপুরের হারাগাছে দালালের হাটের মাহমুদুল কবিরের দোকানে পাওয়া গেল সিগারেটের প্যাকেট থেকে খুলে রাখা বেশকিছু ব্যান্ডরোল।
তিনি জানালেন, ৩০ থেকে ৩৫ টাকা শ’ হিসেবে খোদ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরাই এসব তাদের কাছ থেকে নিয়ে যান। পরে নতুন করে ছাড়া সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহার হয় এসব।
পাশের দোকানি আবদুল ওয়াহেদের দোকানে পাওয়া গেলো নকল ব্যান্ডরোল লাগানো প্যাকেট দেখা যায়।
দোকানি মাহমুদুল কবির বলেন, সিগারেট কোম্পানির বিভিন্ন এজেন্ট আমাদের সিগারেট গায়ে লাগানো ব্যান্ডরোল খুলে সংগ্রহ করে রাখতে বলেন। ১০০টি ব্যান্ডরোল দিলে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পাওয়া যায়। এ জন্য আমরা এগুলো সংগ্রহ করে রেখে দেই।
দোকানদার আবদুল ওয়াহেদ বলেন, বিড়ি কোম্পানির লোকজন বিড়ি দিয়ে যায় আমরা বিক্রি করি। তবে এসব বিড়ির প্যাকেটে লাগানো ব্যান্ডরোল আসল নাকি নকল সেটা আমরা যাচাই করি না। যেভাবে দিয়ে যায় আমরা সেভাবেই বিক্রি করি। এসব দেখার দায়িত্ব কাস্টমসের। সেটা তারাই দেখভাল করবেন।
বিড়ির প্যাকেটের গায়ে যেসব ব্যান্ডরোল লাগানো থাকে সেটি আসল এবং নকল কিনা সেটি সহজেই চেনার উপায় জানালেন রানা নামের এক বিড়ি শ্রমিক। তিনি বলেন, যদি ব্যান্ডরোলটি আসল হয় তাহলে ব্যান্ডরোলের ওপরে পানি দিলে সেটি পুরোটাই সাদা হয়ে যাবে আর যদি নকল হয় পানি দিলেও রং উঠবে না ব্যান্ডরোল থেকে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ এর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ বছরে রংপুর জেলায় বিড়িতে নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহার, ব্যান্ডরোলবিহীন বাজারজাত করার ঘটনায় বিপুল পরিমাণ বিড়ি জব্দসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৬৪ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৫টি মামলা নিষ্পত্তি হলেও এখনো ৭৯টি মামলা বিচারাধীন। এসব নিষ্পত্তি মামলাসমূহের বিপরীতে মোট ১০৩ কোটি ৯ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। তবে এসব ঘটনার সঙ্গে কাস্টমসেরই কেউ কেউ জড়িত বলে অভিযোগ অনেকের।
হারাগাছের দালালের হাটের স্থানীয় যুবক প্রিন্স বলেন, হারাগাছ বিড়ি-অধ্যুষিত এলাকা। এখানে অধিকাংশ বিড়ি ফ্যাক্টরিতেই নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে বাজারজাত করা হচ্ছে; কিন্তু কাস্টমসের কোনো কর্মকর্তাই দেখভাল করছেন না। কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অধিকাংশ বিড়ি ফ্যাক্টরির মালিক এসব করছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
স্থানীয় দোকানি মেজবাহ উদ্দিন বলেন, সরকারের রাজস্ব ফাঁকি রোধে যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা তাদেরই অসাধু কিছু কর্মকর্তা এসব বিড়ি ফ্যাক্টরি মালিকদের সহায়তা করছে।
বাজারে এসব ব্যবহৃত ও নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহার সম্পর্কে কাস্টমসের বক্তব্য নিয়ে কাস্টমস এক্সাইট ও ভ্যাট বিভাগের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ে গেলে কোনো কর্মকর্তায় বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এ ছাড়া নকল ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর সরকার কি পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সে বিষয়েও দেননি কোনো তথ্য।
তবে মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন বলেন, ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শূল্ক আইনের ১১৪ ধারায় শুল্ক ফাঁকির ব্যাপারে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে নকল ব্যান্ডরোলের ব্যাপারে মামলা করতে পারে। মহানগর পুলিশ গঠনের পর ৬ বছরে ৯০টি মামলা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মহানগর পুলিশ গঠনের পর থেকে সরকারের রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। রাজস্ব ফাঁকি যারা দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, রাজস্ব ফাঁকি রোধে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে।
এ দিকে রাজস্ব ফাঁকি রোধে ব্যান্ডরোলের ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন বলেন, ডিজিটাল স্ট্যাম্প সিস্টেম, ব্লক চেইন টেকনোলজির মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে রাজস্ব ফাঁকির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এসব টেকনোলজি এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই ব্যবহার করা হয় যেখানে রাজস্ব টিকিট বা ব্যান্ডরোল জাল করা সম্ভব নয়।
এক সময় ১০০ কারখানায় বিড়ি উৎপাদন হলেও এখন অনলাইনে লাইসেন্স পাওয়া সহজতর হওয়ায় হারাগাছ শহরে ঘরে ঘরে হয়েছে বিড়ির কারখানা।
এসএইচ-১৪/১০/২৩ (উত্তরাঞ্চল ডেস্ক)