তারা দুই ভাই ছিল দিনমজুর। প্রতিদিন যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। দিশেহারা হয়ে এক দালালের খপ্পরে পড়েন তারা দুজন।
ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে দালালের কথামতো অবৈধ পথ ধরে বিদেশযাত্রায় রাজি হন। কিন্তু যাত্রাপথেই নিখোঁজ হন তারা।
প্রায় এক বছর আগে মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের মধ্য পেয়ারপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় রুবেল তালুকদার (৩৫) ও তরিকুল তালুকদার (২৫)। এরা দুজই আপন চাচাতো ভাই।
এ ঘটনার পর নিখোঁজ রুবেল ও তরিকুলের পরিবার মাদারীপুর আদালতে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। তবে মামলার আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
শুক্রবার জানা গেছে, রুবেলের দুই ভাই। রুবেল ঢাকায় একটা চায়ের দোকানে কাজ করে সংসার চালাতেন। কয়েক বছর আগে বিয়েও করেছিলেন। রুবেলের ৫ বছর বয়সী এক ছেলে ও ৩ বছর বয়সী এক মেয়ে আছে। রুবেলের নিখোঁজ সংবাদ শোনার পর থেকে তার বাবা-মা ও স্ত্রী বাকরুদ্ধ।
আর তরিকুলের তিন ভাই। সবার ছোট তরিকুল। বড় ভাই ইতালি প্রবাসী আর মেঝ ভাই সৌদি আরব গিয়ে একটি দুর্ঘটনায় মারা যান। তরিকুলের মা সন্তানের শোকে এখন পাথর। কেউ তার সন্তানদের কথা বলা মাত্রই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জমি বিক্রি করে দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন রুবেল ও তরিকুল। এরপর তারা স্থানীয় দালাল জামাল খানের খপ্পরে পড়ে তার কথামতো লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করে।
দলালের সঙ্গে কথা ছিল ইতালি ঠিকমতো পৌঁছাতে পারলেই টাকা পাবেন দালাল। কিন্তু নানা কারণ দেখিয়ে দুই ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম ধাপেই দালাল নেয় ২০ লাখ টাকা। এরপর পাসপোর্টের মূল কপি নিয়ে ভিসা দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু ভিসা ছাড়াই অবৈধ পথে তাদের গত বছর ১৯ এপ্রিল দুই ভাইকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় দালাল। এরপর থেকেই তারা দুজন নিখোঁজ।
পরিবারের দাবি, নিখোঁজের পরেও ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে দুই পরিবারের কাছ থেকে আরও ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এমনকি মামলা তুলে নিতে ভয় দেখায়। এছাড়াও চক্রটি স্থানীয় সালিশির মাধ্যমে মীমাংসার জন্য নানাভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
তরিকুলের বাবা বারেক তালুকবার বলেন, আমার বয়স হচ্ছে। পরিবারটি নিয়ে আমি আর পারছি না। যা ছিল সব শেষ। কিছুই আর বাকি নাই। শুধু আক্ষেপ তরিকুলকে যদি একবার শেষ দেখা দেখে যেতে পারতাম। ওর মা এখনো ছেলের অপেক্ষায় রোজ চোখের পানি ফেলে। যাকে কাছে পায় তার কাছেই ছেলের কথা জানতে চায়।
রুবেলের মা শাহানা বেগম বলেন, দালাল জামাল খান ও তার মামা আজিজুল তালুকদার বাসায় এসে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার কথা বলে দুজনের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে যায়। আমাদের বলে কোনো ভয় নেই। আমরাও তাদের বিশ্বাস করে টাকা দেই। কিন্তু তারা যে প্রতারণা করবে তা বুঝতে পারি নাই। আমরা আর টাকা ফেরত চাই না। শুধু ছেলেটাকে ফেরত চাই।
তরিকুলের মা হেরন বেগম বলেন, আমার এক ছেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আরেক ছেলের কোনো খবর নেই। কেউ বলে সমুদ্রে নৌকা ডুবে মারা গেছে, আবার কেউ বলে সন্ত্রাসীরা আটকে রাখে। যা আছে আমার সব নিয়ে যান, কিন্তু আমার বুকের মানিকটাকে আপনারা এনে দেন।
জানা গেছে, সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ি এলাকায় মৃত সোনা খানের ছেলে জামাল খান। জামাল দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। জামালের সঙ্গে তার মামা আজিজুল তালুকদার সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। গত এক বছরে তারা এমন ১০ জনকে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রতারণা করে আসছিল। সম্প্রতি এলাকায় এমন আরও ৫টি বিষয় গ্রাম্যসালিশের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে ধামাচাপা দিয়েছে দালাল চক্রটি।
জামাল খানের স্ত্রী ফোনে বলেন, ‘আমরা এখন চট্টগ্রামে থাকি। জামাল এখানে ব্যবসা করে। আমরা বাড়ি কম যাই। স্থানীয় লোকজন আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে উল্টোপাল্টা অভিযোগ করছে, যা সত্য নয়। আমার স্বামী বা আমরা কেউ এর সঙ্গে জড়িত নই।’
এদিকে তরিকুলের বাবা বারেক তালুকদার গত বছর ৪ জুলাই বাদী হয়ে জামাল খানসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে মাদারীপুর আদালতে একটি মামলা করেন। এরপর গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর রুবেলের মা শাহানা বেগম বাদী হয়ে আরও একটি মামলা করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি জামাল খান তার নিকটাত্মীয় ইতালি থাকে। মাত্র ২০ লাখ টাকা খরচ করলেই দুজনকে একসঙ্গে ইতালি নিয়ে যাওয়া যাবে। আর ইতালি গিয়ে ভালো বেতনে চাকরিও দেয়া হবে। এমন প্রলোভন দেখিয়ে গত বছর ১৪ মার্চ তাদের রুবেল ও তরিকুলের বাসায় আসে এবং ২০ লাখ টাকা ও দুজনের মূল পাসপোর্ট নিয়ে নেয় চক্রটি।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে এই মাত্রা আরও তীব্র হয়। এমনকি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০১৭ সালের হিসেবে প্রথম ভাগে অবস্থান করে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মাদারীপুর সদর থানার এসআই শ্যামলেন্দু ঘোষ বলেন, ‘আদালতে মানব পাচারবিষয়ক দুটি মামলা হয়। এই মামলাটি তদন্ত আমার কাছেই আসে। আমি প্রাথমিক তদন্তে বাদী যেসব বিষয় উল্লেখ করেছে তার সত্যতা পাই। এরপর আদালতের কাছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই ঘটনার একটি প্রতিবেদন জমা দেই। এখন আদালত থেকে নির্দেশ এলেই পুলিশ আসামি গ্রেফতারসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।’
বিএ-১২/০৫-০৪ (আঞ্চলিক ডেস্ক)