কুমেক হাসপাতাল কর্মচারীদের টাকার খনি

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির ১৫ কর্মচারী ও তাদের পরিবারের লোকজনের নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ যা তাদের বেতনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। জনসন্মুখে প্রদর্শিত সম্পদের বাইরে তাদের আরও সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ, তৃতীয় শ্রেণির এই কর্মচারীদের কর্মস্থল কুমিল্লা ছাড়াও বিভিন্নস্থানে এসব সম্পদ। তাদের মাধ্যমেই কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঘুষ-দুর্নীতি অনিয়ম সম্পাদিত হয় বলে জনশ্রুতি আছে। সম্প্রতি এই ১৫ জন কর্মচারি মিলে আট কোটি টাকায় একটি বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছেন। কুমিল্লায় দুদকের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সামনে বাড়িটির অবস্থান। অল্প বেতনের এসব কর্মচারি দুদকের চোখের সামনে কীভাবে এই বাড়ি বানালেন এনিয়ে গোটা কুমিল্লাজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাড়ি বললে ভুল বলা হবে। আট শতাংশ জমিতে আলিশান অর্থাৎ রীতিমতো ছয় তলা বিশিষ্ট প্রাসাদ বাড়িটির প্রতিটি ফিটিংস খুবই উন্নত। বিলাসী উপকরণে ঠাসা রাজকীয় বাড়িটি দেখতে কুমিল্লা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডের লোকজন ছুটে আসেন।

অভিযোগ রয়েছে, কুমিল্লা হাসপাতালে কেনাকাটার অর্থ ছাড় করতে হলে এই চক্রকে ঘুষ দিতে হয়। এমনকি এদের বিরুদ্ধে নানাভাবে অর্থ জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে। এদের শুরুর দিকে বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকার মতো। তা বেড়ে এখন ২৫ হাজার মত হয়েছে। অথচ এই তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা এখন অঢেল সম্পদের মালিক। এদের আত্নীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বাড়ি ছাড়াও বেশ কয়েকটি আলিশান বাড়ি, গাড়ি, জমি ও নগদ টাকার মালিক তারা। এসব সম্পদ তাদের স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে করা হয়েছে। এই কর্মচারীরা দীর্ঘ সময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন।

অজ্ঞাত জাদুস্পর্শে অঢেল ধন-সম্পদ যেন ফুলেফেঁপে উঠেছেন তারা। তন্মধ্যে হিসাবরক্ষক দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান আছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা কামরুল হাসান দুর্নীতির মহাগুরু নামে অবিহিত। বাড়িটি অর্থাৎ ইউনাইটেট প্লেস নামের বাড়িটির চেয়ারম্যান ও হাসপাতালের কর্মচারি খায়রুল ইসলাম খান জানান, আমরা হাসপাতালের ১৫ জন স্টাফ মিলে এই আবাসন গড়ে তুলেছি। এটা কোন দুর্নীতির মধ্যে পড়ে না। তবে, ২/১ জন দুর্নীতিবাজ আমাদের মধ্যে আছে। তাদেরকে নিয়ে ঝুট ঝামেলায় আছি। স্থানীয়রা বাড়িটি নির্মাণে ৮ কোটি খরচ হয়েছে জানালেও ইউনাইটেট প্লেস এর চেয়ারম্যান ও হাসপাতালের কর্মচারি খায়রুল ইসলাম খান জানান, এটা ঠিক নয়। বাড়িটি নির্মাণে ৪/৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আঞ্চলিক দুদক অফিসের সামনে এই ভবন জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন জানান, দুদক জানে আমরা মিলে মিশে এই ভবন নির্মাণ করছি।

স্থানীয়রা বলছেন,কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৩য় শ্রেণি এমন বিলাসী জীবনযাপনের টাকার উৎস কোথায়? জানতে চাওয়া হলে তাদের কেও কেও বলেন, ‘আমাদের লেভেলে অনেকেই তিন-চারটি বাড়ি করেছে। আমরা সে তুলনায় বেশি করিনি। হাসপাতালের প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক দেলোয়ার হোসেন, নার্স সাহানা আক্তার, আল মামুন, রায়হানা আক্তার, ফার্মাসিস্ট খাইরুল ইসলাম খান, আজিমউদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা কামরুল হাসান, হারুনুর রশিদ তার স্ত্রীর নামে, ফারুক আহমেদ তার স্ত্রীর নামে, ফারুক আলম ভূইয়া তার স্ত্রীর নামে শারমিন আক্তার এবং আকলিমা আক্তার এই বাড়ির মালিক।

অভিযোগ রয়েছে, ১৯৯২ সাল থেকে দীর্ঘসময় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই কর্মচারিরা কর্মরত আছেন। হাসপাতালে দু’র্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে তারা এখন কোটি টাকার মালিক। নিজেদের ধন-সম্পদ আর আভিজাত্য জানান দিতে মনোরম ডিজাইনে গড়ে তুলেছেন প্রাসাদোপম অট্টালিকা। এতে তাদের খরচ হয়েছে অন্তত আট কোটি টাকা। ১৫ জন কর্মচারি ইউনাইটেড প্লেস নামের বাড়ি অর্থাৎ এই আবাসনের মালিক।

অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতি-লুটপাট আর অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায় আকণ্ঠ ডুবে আছে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই কর্মচারী ও অপরাপর তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের বিপুল বিনিয়োগ আর সদিচ্ছার পরও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না, বরং দিন দিন প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠছে দুর্নীতি-বিশৃঙ্খলার বিশাল বপু শ্বেতহস্তী।

অভিযোগ রয়েছে মাঝে মাঝে গণমাধ্যমের রিপোর্টে বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনিয়ম-দুর্নীতির কদাকার চিত্র বেরিয়ে এলে নামমাত্র তদন্ত কমিটি হয়। বেশির ভাগ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বা সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় না। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনও হয় না।

দুদকের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেন, যারা অসৎভাবে অর্থ উপার্জন করেছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা দরকার। এই দুষ্টচক্রকে ঠেকানো না গেলে রাষ্ট্র ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা বলেন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে এত সম্পদ কীভাবে অর্জন করা যায়, তা নিয়ে সবারই সন্দেহ জাগবে। তারা বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

বিএ-১৩/২১-০১ (আঞ্চলিক ডেস্ক)